২য় ধরনের ডায়বেটিস

রক্তে অতিরিক্ত চিনি আসে কোথা থেকে?

 সূচনাঃ

বাংলাদেশে ২য় ধরনের ডায়বেটিস রোগীর সংখ্যা এখন অনেক। দিনে দিনে সে সংখ্যা আরও বেড়েই চলেছে এবং আশঙ্কাজনকভাবে এই রোগ এখন শিশুদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে, যা ভীষণ দুশ্চিন্তার বিষয়। 

সতর্কতাঃ

এই লেখাটি ২য় ধরনের ডায়বেটিস রোগ সম্পর্কে সাধারণ ধারনা দেবার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। এই লেখা কোন প্রকার চিকিৎসা উপদেশ নয়। অবশ্যই যারা ডায়বেটিস বা উচ্চ রক্ত চাপের জন্য ঔষধ খান, তাদেরকে ডাক্তারের অধীনে সতর্কভাবে এই পরিবর্তন করতে হবে।

ভুল ধারনাঃ

বিষয়টিকে আরও বেশী জটিল করে ফেলছে এই বিষয়ে প্রচলিত ভুল ধারনাগুলো। বিশেষকরে যখন এই ভুল ধারনাগুলোর প্রচারণা চালাচ্ছেন, চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো। "২য় ধরনের ডায়বেটিস একবার হলে আর কোনদিন সারে না, ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে" এমন কথা শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই দায়, যদিও কথাটি কিন্তু একদমই ভুল কথা। প্রমাণ হিসাবে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাটি দেখুন। 

কিন্তু এই কথা ভুল হলে, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ কেন সেই কথাই বলে চলেছেন? তার কারন, এ বিষয়ে সর্বশেষ গবেষনাগুলো সম্পর্কে তারা জ্ঞ্যাত নন। অন্য সমস্যাও আছে। একজন বিশেষজ্ঞ যদি বলেন যে তাঁর পুরনো ধারনাগুলো ভুল ছিল, রোগীরা তখন তাঁর উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন, যা একজন চিকিৎসকের উপার্জনের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ভুল ধারনাই আকড়ে ধরে থাকা স্বল্প মেয়াদে বেশী সহজ। রোগী মরে মরুক! 

দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এতে খতিগ্রস্থ হচ্ছেন রোগীরা। অকারনেই তারা বয়ে বেড়াচ্ছেন এমন একটি অসুখ যা অতি সহজেই সারিয়ে তোলা সম্ভব। যে কোন সমস্যার সমাধান খুঁজতে গেলে, প্রথমে সমস্যাটিকে আমাদের সঠিকভাবে বুঝতে হবে। তাই চলুন, সমাধানের দিকে যাবার পূর্বে, সমস্যা টি পরিষ্কার ভাবে বোঝার চেষ্টা করি। 

সমস্যার ব্যাখ্যাঃ

তাহলে আমাদের সামনে প্রশ্ন হল যে ২য় ধরনের ডায়বেটিস রোগটি আসলে কি? প্রচলিত যে জবাবটি আপনি শুনে থাকবেন, সেটি হচ্ছে যে, এটি হল ইন্সুলিন হরমোনের ঘাটতি জনিত একটি অসুখ। এই ধারনা মতে,  ডায়বেটিস (২য় ধরন) হলে আপনার অগ্নাশয় আর স্বাভাবিক মাত্রায় ইন্সুলিন উৎপাদন করতে পারে না ফলে, রক্তে চিনির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং রক্তে চিনির মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশী বেড়ে যায়। এক কথায় বলতে হয়, এই ধারনাটি ভুল ধারনা, যদিও এর মধ্যে সামান্য সত্য রয়েছে, যা একটু পরেই আমরা আলোচনা করব। তাহলে সঠিক ধারনাটি কি?  কি করে হয় ডায়বেটিস? 

এক কথায়, ২য় ধরনের ডায়বেটিস হচ্ছে, ইন্সুলিন আধিক্য জনিত অসুখ। University of California, Sanfrancisco, USA এর গবেষক প্রফেসর ডঃ রবার্ট লাস্টিগ বললেন যে, এর শুরু হয় অতিরিক্ত চিনি খাওয়া থেকে। অন্য আরও একটি উপায়ে এই অসুখের শুরু হতে পারে যদি আমরা খুব বেশী শ্বেতসার জাতীয় খাবার খাই। কিন্তু চিনি খাওয়াটাই প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এই রোগের জন্ম দেয়। 

মিষ্টি চিনি নাকি মিষ্টি বিষঃ 

মিষ্টি চিনি যা আমরা বাজার থেকে কিনে আনি, বা ফলের মধ্যে যে চিনি থাকে, তাঁর নাম হল ফ্রুক্টজ। এই চিনি আমাদের কলিজাতেই শুধুমাত্র প্রক্রিয়াজাত হতে পারে। গ্লুকোজকে গ্লাইকজেন আকারে আমাদের দেহ জমা রাখতে পারে, কিন্তু ফ্রুক্তজের ক্ষেত্রে তা হয় না। ফলে যতটুকু চিনি আমরা খাই, তাঁর পুরটাই কলিজায় চর্বি আকারে জমা হয় এবং নন এলকহলিক ফ্যাটি লিভার অসুখটি দেখা দেয়। লিভারে চর্বি বেশী জমে গেলে, লিভারের কোষগুলোর কাজে ব্যঘাত হয় এবং তারা ইন্সুলিন হরমোনের প্রভাবে আর আগের মত কাজ করে না। অন্য কথায়, ইন্সুলিন হরমোন তাঁর কার্যকারিতা হারায়। অর্থাৎ লিভার তখন ইন্সুলিন রেসিস্ট্যান্ট হয়ে পড়ে।  বিষয়টি সমাধান করার জন্য, অগ্নাশয় আরও বেশী ইন্সুলিন উৎপাদন করে রক্তে মিশিয়ে দেয়। এই অবস্থা কিছুদিন ধরে চলতে থাকলে, আমাদের দেহের অন্য অঙ্গগুলোও ইন্সুলিন রেসিস্ট্যান্ট হয়ে পরে এবং ইন্সুলিন হরমোনের সঙ্কেতে আর আগের মত কাজ করে না। এই অবস্থায় স্বাভাবিক মাত্রার ইন্সুলিন দিয়ে, খাওয়ার পরে রক্তে যে চিনি বাড়ে, সেই চিনি কে রক্ত থেকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। এই অবস্থাটি কে বলা হয় ইন্সুলিন বধিরতা বা ইন্সুলিন রেসিস্ট্যান্স। এর সমাধানের জন্য আমাদের অগ্নাশয় আরও বেশী ইন্সুলিন উৎপাদন করে, যা তখনকার মত রক্ত থেকে চিনি সরিয়ে নিতে পারলেও,  ইন্সুলিন বধিরতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়া ১০ বা ১৫ বছর ধরে চলার পরে এমন একটা অবস্থা আসে যখন, আমাদের অগ্নাশয় স্বাভাবিক মাত্রা থেকে ৭ থেকে ১০ গুন ইন্সুলিন উৎপাদন করলেও, রক্তের চিনি সরাতে তা যথেষ্ট হয় না। তখনই রক্তের চিনি পরীক্ষা করে ডাক্তার আমাদের বলেন যে আমাদের ডায়বেটিস হয়েছে। 

ইনসুলিন বধিরতাঃ 

তাহলে বুঝতেই পারছেন যে, রক্ত থেকে চিনি সরাবার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক মাত্রার ইন্সুলিন থেকে অনেকগুণ বেশী ইন্সুলিন উৎপাদন করলেও, সেই পরিমাণ ইন্সুলিন আমাদের দেহের জন্য যথেষ্ট হয় না। তাঁর মানে এক অর্থে যদিও সেটা ইন্সুলিনের ঘাটতি জনিত রোগ, কিন্তু এই ঘাটতির উৎস হচ্ছে দেহে অত্যাধিক মাত্রায় ইন্সুলিনের উপস্থিতি, যার কারণ হচ্ছে দেহের বিপাক প্রক্রিয়া ভেঙ্গে পড়া।  

এই কারণেই, এমন রোগীদের বাইরে থেকে ইন্সুলিন দিলে, তাদের রক্তে চিনির মাত্রা স্বাভাবিক হয়, কিন্তু এই অতিরিক্ত ইন্সুলিন যেহেতু ইন্সুলিন বধিরতা কে আরও বাড়িয়ে দেয়, তাই কদিন পরে আপনাকে আরও বেশী ইন্সুলিন গ্রহণ করতে হয়। এবং এই প্রাণঘাতী চক্র চলতেই থাকে। 

এখন রক্ত থেকে চিনি সরিয়ে নেওয়াই যদি ইন্সুলিনের একমাত্র কাজ হত, তাহলে আপত্তি করার কিছু থাকত না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে ইন্সুলিন আমাদের দেহের প্রতিটি কোষ এর কাজ কে প্রভাবিত করে। দেহে শক্তির উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত হয় এই হরমোনের প্রভাবে। 

রক্তে ইন্সুলিন বেশী থাকলে, প্রতিটি কোষ তখন শক্তি জমিয়ে রাখার চেষ্টা করে চর্বি আকারে এবং শক্তির ব্যবহারে বাধা দেয়। ফলে ওজন বাড়তে থাকে। 

দুর্বলতা দেখা দেয়। দেহের এমন সব অঙ্গে চর্বি জমে যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায় চর্বি জমার কথা নয়, যেমন চোখ, কিডনি, অগ্নাশয় ইত্যাদি। 

অতিরিক্ত ইন্সুলিনের উপস্থিতি আমাদের দেহের অতি সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করে। ফলে দেখা দেয় হৃদরোগ বা কিডনি রোগ। 

এর প্রভাবে মেয়েলি এবং পুরুষালি হরমোন গুলোর কাজ ব্যাহত হয় এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে পিসিওএস রোগ, অবাঞ্ছিত লোম (গোঁফ, দাড়ি) হয় এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যৌন অক্ষমতা, পেশীহীন দেহ, ঝুলে পরা স্তন ইত্যাদি। 

মস্তিষ্ক ইন্সুলিন বধির হয়ে গেলে, তা চিনি থেকে শক্তি উৎপাদন করতে পারে না এবং ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমার্স অসুখ দেখা দেয়। 

ইন্সুলিন যেহেতু একটি প্রবৃদ্ধি জাতীয় হরমোন, এর আধিক্য আমাদের দেহে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন ঘটাতে পারে। যার অন্য নাম ক্যান্সার রোগ। 

আশা করি বুঝতে পারছেন যে, ইন্সুলিন বধিরতা থাকলে, দেহের কাজের জন্য অধিক মাত্রায় ইন্সুলিন প্রয়োজন হয়, যা আবার একাধিক অসুখের কারন। এই অসুখগুলো কে একত্রে 'মেটাবলিক সিনড্রোম' জনিত রোগ বলা হয়। বাংলায় বলতে হবে বিপাক বিভ্রাট জনিত রোগ। 

সমাধানঃ

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই অসুখগুলোর একটা বড় কারন হল ইন্সুলিন বধিরতার সাথে রক্তে অতিরিক্ত ইন্সুলিনের উপস্থিতি। ইন্সুলিন বধিরতার সমাধান করতে পারলেই তাহলে এই অসুখগুলো সেরে যাবে। সেটা কি করে করব তাহলে? 

একটু আগেই বলেছিলাম যে, এই ইন্সুলিন বধিরতার সূত্রপাত হয় অতিরিক্ত পরিমাণে ফ্রুক্টজ জাতীয় চিনি খেলে। তাহলে সমাধানের জন্য প্রথমে সেটা বন্ধ করতে হবে। এতে করে কলিজায় জমে থাকা চর্বি কমতে শুরু করবে এবং কলিজার ইন্সুলিন বধিরতা কমে যাবে। প্রফেসর ডঃ রবার্ট লাস্টিগ ফ্যাটি লিভার অসুখে আক্রান্ত ৪৩ জন শিশুর খাবার থেকে ফ্রুক্টজ চিনি কমিয়ে তার পরিবর্তে গ্লুকোজ দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে দেহের ওজন অপরিবর্তিত রাখতে স্বাভাবিক মাত্রা থেকে বেশী ক্যালরি খাওয়ানোর পরেও, মাত্র ৯ দিন সময়ে তাদের কলিজার চর্বি অনেক কমে যায় এবং তাদের ইন্সুলিন বধিরতা কমে যায়। গবেষণা প্রতিবেদনটি পড়তে এই লিংক ক্লিক করুন। তাহলে সেটা হল প্রথম কাজ। 

দ্বিতীয়ত, ইন্সুলিন হরমোনটির প্রয়োজন পড়ে প্রতিবেলা খাবারের পরে ও খাবারে শর্করা থাকলে। শ্বেতসার জাতীয় খাবারগুলো হজমের পরে চিনিতে পরিণত হয়  এবং রক্তে চিনির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই চিনি কে সরিয়ে নিতেই ইন্সুলিনের প্রয়োজন পড়ে। 

তাহলে, আমরা যদি ঘন ঘন না খাই এবং খাবার থেকে শর্করা জাতীয় খাবারগুলো কমিয়ে দেই, তাহলে দেহে ইন্সুলিন সর্বক্ষণ বেড়ে থাকে না। আগে যেখানে দিনের ১৪ থেকে ২০ ঘণ্টা রক্তে উচ্চ মাত্রায় ইন্সুলিন থাকত, এই নতুন ব্যবস্থায় সেখানে ইন্সুলিন থাকে ৩/৪ ঘন্টা। ফলে, ইন্সুলিন বধিরতা কমতে থাকে। অন্যদিকে, ইন্সুলিন এর মাত্রা কমে গেলে, দেহ চর্বি আকারে জমানো শক্তি ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও দেখা যায়, উপোষ করলে দেহে শক্তি থাকে অনেক বেশী এবং ক্ষুধাও পায় না। বেশি শক্তি উৎপাদন হলে, আমরা পরিশ্রম করতে আগ্রহী হই এবং ব্যায়াম করা তখন অনেক সহজ হয়। ওজন কমে যায় কোন চেষ্টা ছাড়াই। 

অনেক ডাক্তার বলে থাকেন যে অগ্নাশয় নষ্ট হয়ে যায় ডায়বেটিস রোগ হলে। সে কথা ১ম ধরনের ডায়বেটিসের ক্ষেত্রে সত্য হলেও, ২য় ধরনের ক্ষেত্রে অতি অল্প রোগীর বেলায় তা ঘটতে পারে। ২০ বা ৩০ বছর অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিস নিয়ে বেঁচে থাকলে, তখন সে অবস্থা কারো কারো হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই, ডঃ স্টিফেন ফিনি দেখেছেন যে, অতিরিক্ত চর্বির কবলে পড়ে অগ্নাশয় কাজ না করলেও, দেহের চর্বি কমার সাথে সাথে অগ্নাশয়ের বিটা কোষগুলো তাদের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা আবার ফিরে পায় এবং তাই, বাইরে থেকে ইন্সুলিন নেবার দরকার পরে না। 

এই অবস্থায় পৌঁছে গলে, তখন মাঝে মাঝে সামান্য শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়াও যায়।  এবারে বলুন, এটা সহজ কি না?

যদি কারো ডায়েট চার্ট প্রয়োজন হয়, তাহলে আমাদের এই পাতা টি পড়ে দেখুন।