পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS)

পিসিওএস বা দানাদার জরায়ু রোগ, অতি সহজে নিরাময়যোগ্য একটি অসুখ। এই অসুখটি ঘন ঘন অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার কারণে হয়ে থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। চিনি বলতে এখানে মিষ্টি চিনি তো বটেই, এমন কি মিষ্টি নয়, এমন চিনিকেও বোঝানো হচ্ছে। সহজ কথায়, শর্করা জাতীয় খাবারের কথা বলছি আমরা। মিষ্টি চিনি অবশ্য সব থেকে বেশি নেতিবাচক ভূমিকা রাখে এই অসুখের ক্ষেত্রে। 

ভাবছেন, জরায়ুর অসুখ, তাতে চিনি আবার কি করল? চলুন প্রথমে তাহলে বোঝার চেষ্টা করি যে একজন সুস্থ্য নারীর ক্ষেত্রে কি ঘটে। আমার এই ব্যাখ্যাটি ব্রিগাম ইয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ বেন বিকম্যান এর কাছ থেকে শেখা। 

মানুষ পুরুষ বা নারী হয় দুটো হরমোনের উপর নির্ভর করে। টেস্টোস্টেরন/এন্ড্রোজেন  এবং ইস্ট্রোজেন। পুরুষদের দেহে প্রথমটি বেশি থাকে এবং নারীদের দেহে দ্বিতীয়টি। তবে নারীদের দেহে ইস্ট্রোজেন হরমোন আসলে এন্ড্রোজেন হরমোন থেকেই উৎপাদিত হয়। নারীদেহ প্রথমে এন্ড্রোজেন উৎপাদন করে এবং পরে তা বিভিন্ন হরমোন এবং এনজাইমের প্রভাবে ইস্ট্রোজেনে পরিণত হয়। দেহে স্বাভাবিক মাত্রায় ইস্ট্রোজেন থাকলে এবং এন্ড্রোজেন না থাকলে, নারীদের মাসিকচক্র স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়মত তাদের ডিম্বক নিঃসৃত হয় এবং জরায়ুতে এসে যথাযথ সময় নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়। এই পুরো সময়ে, হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকা অতি জরুরী।  

পিসিওএস অসুখে কি ঘটে? ডিম্বক তার স্বাভাবিক যাত্রা শুরু করলেও, মাসিক চক্রের মাঝামাঝি সময়ে জরায়ুর মধ্যে এসে প্রস্ফুটন সম্পন্ন করার আগেই, দেহে এন্ড্রোজেন (পুরুষ হরমোন) বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। অন্য কথায়, পুরুষ হরমোন যথাযথভাবে নারী হরমোনে রূপান্তরিত হয় না। ফলে ইস্ট্রোজেন বা নারী হরমোনের অভাবে, ডিম্বকের প্রস্ফুটন বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে নিষেকর জন্য উপযুক্ত ডিম্বক হিসাবে জরায়ুর মধ্যে আত্মপ্রকাশের পরিবর্তে, এই অসম্পূর্ণ ডিম্বকটি জরায়ুর দেয়ালে একটি দানা/গোটা আকারে আটকে থাকে। স্বাভাবতই, ডিম্বকটি সঠিক সময়ে জরায়ুতে আত্মপ্রকাশ না করলে, মা হবার সম্ভাবনাও থাকে না। মাসিক চক্রও অনিয়মিত হয়। পরীক্ষা করলে তখন ধরা পরে  দানাদার জরায়ু রোগ। 

তাহলে বুঝতে পারছেন আশা করি যে, পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন যদি ঠিকমত ইস্ট্রোজেনে পরিণত হত, তাহলে এই সমস্যা হতই না। প্রশ্ন হচ্ছে, নারীদেহে তো স্বাভাবিক ভাবেই এই পরিবর্তন হবার কথা ছিল, তাহলে হল না কেন? এর উত্তরে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন যে, ইনসুলিন হরমোনটি এই রূপান্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইনসুলিন হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলে, নারীদেহে সঠিকভাবে ইস্ট্রোজেন হরমোন উৎপাদিত হয়। কিন্তু ইনসুলিন যদি মাত্রাতিরিক্ত থাকে, তাহলে এন্ড্রোজেন সঠিকভাবে ইস্ট্রোজেনে পরিণত হয় না। এতে দুটো ঝামেলা হয়। প্রথমত, ডিম্বকের স্বাভাবিক প্রস্ফুটন বাধা প্রাপ্ত হয় এবং দ্বিতীয়ত, নারীদেহে পুরুষ হরমোন বেশি হয়ে যায়। সেকারণেই দানাদার জরায়ু রোগে আক্রান্ত নারীদের দেহে কতগুলো পুরুষালি পরিবর্তন দেখা দেয়। কণ্ঠ মোটা হয়ে যায়, দাড়ি-গোঁফ গজাতে শুরু করে, মাথায় পুরুষালি টাক পড়তে থাকে ইত্যাদি। এই অসুখ সম্পর্কে যারা জানেন, তারা এক নজর দেখেই এই অসুখের সম্ভাবনা আন্দাজ করতে পারেন। 

মুল সমস্যাটি তাহলে কি? সেটি হল, দেহে মাত্রাতিরিক্ত ইনসুলিন হরমোনের উপস্থিতি। ইনসুলিন বেড়ে থাকে কেন? সেই পুরনো গল্প। ঘন ঘন অতিরিক্ত শর্করা সমৃদ্ধ খাদ্য খেলে, দেহে ইনসুলিন বৈরিতা শুরু হয়, যার অর্থ হল, দেহে ইনসুলিন হরমোন উৎপাদনের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যায়। একারণেই দানাদার জরায়ু আক্রান্ত নারীদের সাধারণত ওজন বেশি হয়, উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়, ২য় ধরনের ডায়বেটিস ধরা পরে, ঘাড় এবং বগলের ত্বক কালো খসখসে হয়ে যায়, দেহে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট আঁচিল দেখা দেয়, ব্রণ বেশি হয় ইত্যাদি। 

তাহলে সমাধান এখন খুব সহজ! ঘন ঘন শর্করা সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকলে, মিষ্টি খাবার বা পানীয় না খেলে, খাবার থেকে শর্করা কমিয়ে দিলে বা বাদ দিলে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ইনসুলিন বৈরিতা দেহ থেকে বিদায় হয়। ইনসুলিন হরমোনের মাত্রা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় নেমে আসে। তখন ইস্ট্রোজেন হরমোন উৎপাদন স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং মাসিক চক্র স্বাভাবিক হয়ে যায়। 

যারা এই রোগের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন, তাদের অনেককেই ডাক্তার 'মেটফরমিন' ঔষধটি দিয়েছেন। ভেবে দেখেছেন যে কেন আপনাকে মেটফরমিন দেয়া হল? সেটা তো ডায়বেটিক রোগীদের রক্তে চিনি যেন না বাড়ে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য দেয়া হয়, তাই না?  মেটফরমিন খেলে তাহলে রক্তে চিনি বেড়ে থাকে না, তার মানে ইন্সুলিনের প্রয়োজন কমে যায়, তার মানে অতিরিক্ত ইনসুলিন নিঃসরণের সম্ভাবনা কমে এবং রোগী উপকার পান! অর্থাৎ রোগী প্রথমে চিনি খেয়ে, তারপরে মেটফরমিন খেয়ে সেই চিনি কমিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। সেটা একটু বোকা বোকা ব্যপার হয়ে যায়, তাই না? 

তবে কেউ অবশ্য বলতে পারেন যে, শুধুমাত্র একটা ঔষধ টক করে খেয়ে নিলে যদি স্বাধীনভাবে মজার মজার সব খাবার যত খুশি, যখন খুশি খাওয়া যায়, তাহলে দোষ কি? দোষটা হচ্ছে যে, এই পদ্ধতিতে আপনার দেহে ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটে। আপনার সন্তানের দেহে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন হতে পারে এই ঔষধের প্রভাবে। তাছাড়া, "ঔষধ খেলেই সেরে যাবে"-এই ভুল ধারনা আপনার মনের মধ্যে থাকলে, আপনি আরও বেশি বেশি অনিয়ম করতে উৎসাহী হবেন এবং ঔষধ তখন আপনাকে আর সুরক্ষা দিতে পারবেন না। আপনি বিপাক বিভ্রাট (মেটাবলিক সিন্ড্রোম) আক্রান্ত হয়ে অকালেই পটল তুলবেন। 

অন্যদিকে, আপনি যদি ঔষধ ছাড়াই নিয়ম-শৃঙ্খলার মাধ্যমে দেহ কে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন, তাহলে বর্তমান সময়ে আমরা যে অসুখগুলোকে সভ্যতার অভিসাপ বলছি, সেগুলো হবে না। আপনি দীর্ঘ একটি সুস্থ্য জীবন লাভ করবেন। সহজ কিনা বলুন? 

কেমন হবে আপনার খাদ্যাভ্যাস? ডাঃ ডেভিড আনউইন তার রোগীদের জন্য যে খাদ্যতালিকা তৈরি করেছেন, আপনারা সেটা ব্যবহার করতে পারেন। সেটিকে পাওয়া যাবে এইখানে ক্লিক করলে। 

( সতর্কতাঃ যদি আপনারা উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ঔষধ ব্যাবহার করেন, তাহলে একজন চিকিৎসকের তত্বাবধানে থেকে এই পরিবর্তনগুলো করবেন, কেননা এই পরিবর্তন আপনার রক্তচাপ এবং ডায়বেটিস কে সুস্থ্যতার দিকে নিয়ে যাবে এবং সময় মতো তাই ঔষধ না কমালে, উল্টোদিকে বিপত্তি হতে পারে।)