স্থূলতা

ওজন নিয়ন্ত্রণ করবেন কি করে? 

এই প্রশ্নের উত্তরে, যারা ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য চেষ্টা করেছেন, তারা বলেন যে বিষয়টি মোটেও সহজ নয়। খাওয়া কমিয়ে এবং সকাল সন্ধ্যা অনেক পরিশ্রম করেও ওজন কে কাঙ্ক্ষিত স্থানে নামিয়ে আনা যায় না। কেউ কেউ শুনেছেন যে দুঘণ্টা পরপর খেলে দেহের বিপাকের মাত্রা বাড়বে এবং তাই ওজন কমবে। কিন্তু এই উপায়েও কেউ সফলতা পেলেন না। অনেকেই তাই ধরেই নিয়েছেন যে ওজন কমানো আসলে সম্ভব নয়। 

ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক সমাধান আসলে অন্য একটি প্রশ্নের জবাবের মধ্যে রয়েছে। সেই প্রশ্নটি হল "ওজন বাড়ে কেন?"। চলুন এই প্রশ্নের জবাব বোঝার চেষ্টা করি। 

আমাদের দেহের অঙ্গগুলোর মধ্যে আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সম্পাদিত হয় দেহাভ্যন্তরস্থ কতগুলো গ্রন্থি নিঃসরিত রসের মাধ্যমে। এই রস গুলোকে আমরা হরমোন বলি। এখন, ওজন বাড়ার জন্য দেহে বেশি বেশি  চর্বি উৎপাদন হতে হয় এবং সেই চর্বির জমা থাকতে হয়। চর্বি উৎপাদন এবং জমা করার সংকেত আসে যদি রক্তে ইনসুলিন নামের একটি হরমোন বেরিয়ে আসে। আমাদের পাকস্থলীর ঠিক পরেই অগ্নাশয় নামে একটি অঙ্গ রয়েছে যা রক্তে গ্লুকোজ বা চিনি বাড়লেই, রক্তে ইনসুলিন হরমোন মিশিয়ে দেয়। এই ইনসুলিন আমাদের যকৃত বা কলিজা এবং সব পেশী কে রক্ত থেকে এই চিনি শুষে নিয়ে গ্লাইকোজেন আকারে জমা করে রাখার জন্য সংকেত দেয়। পেশী এবং যকৃত যতটা সম্ভব চিনি শুষে নেবার পরেও যদি রক্তে আরো চিনি থাকে, তখন ইনসুলিন যকৃতকে নির্দেশ দেয় এই চিনি চর্বি তে রূপান্তর করে দেহের চর্বি কোষ গুলোর মধ্যে জমা করে রাখতে। 

এই সময়ে একই সাথে চর্বি পুড়িয়ে ফেলা নিষিদ্ধ করে রাখে ইনসুলিন। কেননা একদিকে চর্বি উৎপাদন করে একই সাথে অন্যদিকে চর্বি পোড়ানো তো অব্যাবস্থাপনার প্রমাণ, তাই না? মোদ্দা কথা হল, রক্তে ইনসুলিন থাকলে চর্বি উৎপাদন এবং জমা করা চলবে এবং জমে থাকা চর্বি পোড়ানো বন্ধ থাকবে। এই অবস্থা যদি বেশি সময় ধরে চলে, তাহলে ওজন বাড়বে। 

বিষয়টিকে আরো জটিল করে তোলে একটি অবস্থা যা ইনসুলিন বৈরিতা বা Insulin resistance নামে পরিচিত। আসুন একটু বোঝার চেষ্টা করি। বৈরিতা আমাদের দেহের একটি অতি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কোন সংকেত বা উদ্দীপক যদি স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক বেশি সময় দেহে উপস্থিত থাকে, তখন দেহ সেই উদ্দীপককে অবজ্ঞা করে দেহকে মাত্রাতিরিক্ত উদ্দীপনার হাত থেকে রক্ষা করে। একটি উদাহরণ দিলেই সকলে বিষয়টি বুঝে ফেলবেন। সকলেই জানেন যে একই ব্যাকটেরিয়ানাশক ঔষধ কিছুদিন একাধারে ব্যবহার করলে, সে ঔষধের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ,  ভবিষ্যতে সেই একই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সে ঔষধ আরে কাজ করে না। জীব কোষের ক্ষেত্রে এটি একটি সহজাত আচরণ। কোন উদ্দীপক যদি অনাকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উদ্দীপনা চালিয়ে যেতে থাকে, তাহলে জীবকোষ সেই উদ্দীপকের প্রতি বৈরি হয়ে পরে এবং সেখান থেকে আসা স্বাভাবিক মাত্রায় উদ্দীপনা তখন জীবকোষ অবজ্ঞা করে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য উদ্দীপক কে আরো বেশি মাত্রায় উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হয়। এভাবে একটি অতল-চক্র শুরু হয় যেখানে উদ্দীপক বেড়ে কাজ সম্পাদন করলেও দেহ নতুন মাত্রার উদ্দীপকে বৈরি হয়ে পরে এবং উদ্দীপক কে আরও বাড়াতে হয়। 

ইনসুলিনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা কিভাবে ঘটে? ধরুন একজন হয়ত ঘনঘন খেতে শুরু করলেন। প্রতিবার খাওয়ার পরেই তার রক্তে চিনির মাত্রা বাড়ছে এবং সেই চিনি কে সরিয়ে নিতে আসছে ইনসুলিন। একবার ইনসুলিন রক্তে এলে, সেটা রক্ত থেকে পরিষ্কার হতে ৪/৫ ঘণ্টা সময় নেয়। তাহলে এই ব্যক্তি সকালে নাস্তা খাওয়ার পর থেকে শুরু করে মধ্যরাত অব্দি তার রক্তের ইনসুলিন বেড়েই থাকবে। কিছুদিন এমন চললে, তার দেহের কিছু অঙ্গ ইনসুলিন বৈরি হয়ে পড়বে। অর্থাৎ, স্বাভাবিক মাত্রায় ইনসুলিন তখন কাজ করবে না। কাজ না করলে, রক্তে চিনির মাত্রা বেড়েই থাকবে এবং অগ্নাশয় আরো বেশি ইনসুলিন উৎপাদন করে রক্তে মিশিয়ে দেবে। শুরু হবে সেই অতল-চক্র। ওদিকে আমাদের যকৃতের চর্বি উৎপাদনকারী কোষগুলো দেখা গেছে যে কখনোই বৈরি হয় না। অর্থাৎ ইনসুলিন এর মাত্রা যত বাড়ে, তত বেশি তারা চর্বি উৎপাদন করে এবং ওজন বাড়তেই থাকে প্রতিদিন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ওজন বাড়ার বিষয়টি ইনসুলিনের সাথে খুব শক্তভাবে জড়িত। তাহলে ইনসুলিন কে যদি কমিয়ে রাখা যায়, তাহলে ওজন বাড়ার আর উপায় থাকবে না। অন্য দিকে, ইনসুলিন রক্তে না থাকলে যেহেতু দেহের চর্বি খরচের প্রক্রিয়া চালু হয়, তাহলে ইনসুলিন কমিয়ে রাখতে পারলে, দেহের জমে থাকা চর্বিও কমতে পারে এবং ওজন কমতে পারে।

কিন্তু দেহ ইনসুলিন বৈরি হলে? সেখানেও দেখা গেছে যে, যদি দেহকে প্রতিদিন একটা লম্বা সময় ইন্সুলিন শূন্য রাখা যায়, তাহলে দেহ আবার তার সংবেদনশীলতা ফিরে পায়। অর্থাৎ কিছুদিন পরে স্বাভাবিক মাত্রার ইন্সুলিন রক্তে মিশে গেলেই, রক্ত থেকে চিনি পেশির মধ্যে ঢুকে পরে। অর্থাৎ ইন্সুলিন কে রক্তের মধ্যে বেশি সময় ধরে ভেসে বেড়াতে হয় না। ইনসুলিনের মাত্রা কমে গেলে, ওজন বাড়ার প্রক্রিয়াও স্থিমিত হয়ে আসে। 

ইনসুলিনকে তাহলে কমিয়ে রাখা যায় কিভাবে? খুব সোজা। শর্করা জাতীয় খাবারগুলোই যেহেতু হজম হবার পরে রক্তে গ্লুকোজ আকারে প্রবেশ করে এবং তখন ইন্সুলিন নিঃসরণের প্রয়োজন হয়, তাই খাবার থেকে শর্করা সরিয়ে দিলেই দেখা যায় ইনসুলিনের মাত্রা কমে যায় নাটকীয়ভাবে।

অনেকেই এই কথায় মাথা চুলকে ভাবছেন শর্করা আবার কোনগুলো, তাই তো? তাদের জন্য আরও সহজ উপায় হচ্ছে উপোষ করা। যদি কিছুই না খান, তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে আপনি শর্করাও খাচ্ছেন না। তাছাড়া প্রতিদিন ১৬-১৮ ঘণ্টা উপোষ করার অভ্যাস থাকলে, ১২ ঘণ্টা পরেই দেহে অটোফেজি বা "নিজেকে খাওয়া" নামের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ায় দেহের কোষগুলো তাদের ভেতরে যদি কোন আবর্জনা থাকে বা অপ্রয়োজনীয় কিছু থাকে, তা পরিষ্কার করতে শুরু করে। যারা এই ব্যাবস্থাটি অনুসরণ করেন, তারা অতি দ্রুত ওজন কমাতে সক্ষম হন এবং তাদের ত্বকও ঝুলে পড়ে না। দেহের আকৃতি পরিবর্তনের সাথে সাথে ত্বকের যে অংশ দেহের প্রয়োজন থাকে না, অটোফেজি প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে তা দেহ ভেঙ্গে সরিয়ে নেয় এবং শক্তি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করে।

ব্রিঘাম ইয়ং ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডঃ বেঞ্জামিন বিকম্যান ওজন কমাবার জন্য তাই নিম্ন লিখিত নিয়ম মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করেনঃ
১। সকাল এবং দুপুর দুই বেলা ভরপেট খাওয়া। পারিবারিক বা সামাজিক কারণে রাতের বেলায় খেতে বাধ্য হলে বরং দুপুর এবং রাতে খাওয়া। 
২। খাবার থেকে শর্করা সমৃদ্ধ শস্যভিত্তিক খাবার (ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি দিয়ে বানানো যে কোণ খাবার) এবং শ্বেতসার সমৃদ্ধ খাবার যেমন আলু পরিত্যাগ করা।
৩। এই দুই বেলার বাইরে আর কোন খাবার বা নাস্তা না খাওয়া।
৪। ঘুমাতে যাবার কমপক্ষে ৩/৪ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার খেয়ে নেওয়া।
৫। প্রয়োজন মাফিক কালো চা বা কফি খাওয়া যেতে পারে।
৬। সঙ্গত কারণেই এই নিয়ম মানলে মাছ মাংশ বেশি খেতে হবে এবং চর্বিযুক্ত মাংশ খেতে ভয় করার কোন কারণ নেই। 

যারা আরও বিস্তারিত জানতে চান, তারা যুক্তরাজ্যের ডাক্তার ডাঃ ডেভিড আনউইন এর ডায়েট চার্ট অনুসরণ করতে পারেন যা আমাদের ওয়েবসাইটের এই লিংকে ক্লিক করলেই পাবেন। 

অনেকেই হয়তো শঙ্কা করবেন যে শর্করা খাওয়া বন্ধ করে দিলে কি করে চলবে? সেটাইতো আমাদের দেহের মূল শক্তির উৎস, তাই না? ব্যাপার হচ্ছে, একজন স্বাভাবিক ওজন সম্পন্ন সুস্থ্য মানুষের জন্যে শর্করাকে শক্তির জ্বালানি হিসাবে ব্যাবহার করাতে দোষ নেই। কিন্তু যখন আপনার ওজন অতিরিক্ত হয়ে গেছে, তখন বুঝতে হবে যে আপনার দেহ আর সুস্থ্য স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এমতাবস্থায় শর্করা কে শক্তির উৎস হিসাবে ব্যাবহার করলে, ফলাফল ভাল হবে না। ভেবেই দেখুন না, যদি তা না হত, আপনি কি অতিরিক্ত ওজনে ভুগতেন? 

আমাদের দেশের কিছু স্বল্প শিক্ষিত (মূর্খ বললে যদি রেগে যান, তাই সাবধানতার সাথে শব্দ চয়ন করলাম) ডাক্তার দাবি করেন যে শর্করা না খেলে আমরা "হাইপোগ্লাইসিমিয়া" বা রক্তে চিনির অতিস্বল্পতাহেতু মৃত্যুবরণ করতে পারি। এই কথাটি আসলে নিছক ভয় দেখানোর জন্যেই বলা। রক্তে চিনির অতিস্বল্পতা শুধু এমন একজনের হতে পারে যিনি ২য় ধরনের ডায়বেটিস ব্যবস্থাপনার অংশ হিসাবে ইন্সুলিন ইনজেকশন আকারে গ্রহণ করেন বা শক্তিশালী চিনি কমানোর ঔষধ গ্রহণ করেন। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এটি অসম্ভব, কেন? কারণ, আমাদের যকৃত রক্তে চিনির মাত্রা কম হলে, সাথে সাথে "গ্লুকোনিওজেনেসিস" প্রক্রিয়ায় চিনি উৎপাদন করে রক্তে মিশিয়ে, রক্তে চিনির মাত্রা ঠিক রাখে।

স্বাস্থ্যসেবী বলেছেন "চিনিই আপনার মস্তিষ্কের প্রধান জ্বালানি এবং তাই চিনি না খেলে আপনার মস্তিষ্ক কাজ করবে না"? দয়া করে এমন স্বাস্থ্যসেবীর কাছে আর যাবেন না। ইনিও সম্মানিত 'স্বল্প শিক্ষিত' দের দলের লোক। এ কথা ঠিক যে, চিনি মস্তিষ্কের জন্য অত্যাবশ্যকীয়, কিন্তু যে পরিমাণে চিনি প্রয়োজন মস্তিষ্কের, সে পরিমাণ চিনি আপনার কলিজা হেসে-খেলে তৈরি করে দিতে পারে এবং দেয়। তা না হলে, সারারাত ঘুমিয়ে থাকার পরে সকালে আপনি জীবিত থাকতেন না। এ বিষয়ে আমাদের "জনপ্রিয় ভুল" ধারনার পাতায় বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। একবার দেখে নিতে অনুরোধ করব। 

এই বিষয়ে আপনারা একটু খোঁজ করলেই বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে আপনি যদি ডায়বেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ঔষধ খান, তাহলে একজন সুশিক্ষিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন করবেন। এই খাদ্যাভ্যাস অনেক ক্ষেত্রেই আপনার ঔষধ থেকে বেশি শক্তিশালী এবং তাই এই অভ্যাস এবং ঔষধ এক সাথে ব্যাবহার করলে, বিপত্তি হতে পারে। ধন্যবাদ।