মনোরোগ

হার্ভার্ড প্রফেসর বলছেন মানুষিক রোগ সারাতে কিটো ডায়েট কার্যকর এবং বিজ্ঞান সম্মত। 

প্রফেসর ক্রিস পাল্মার, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুল এবং একটি হাসপাতালে কর্মরত আছেন। একজন মনোরোগ চিকিৎসক এবং নিজেও বহুদিন ভুগেছেন মনোরোগে। কিটোজেনিক ডায়েট ব্যাবহার করে তিনি নিজে সুস্থ্য জীবন ফিরে পেয়েছেন এবং সাথে সারিয়ে তুলেছেন অনেক রোগীদের। 

বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে স্নায়ু ও মস্তিষ্ক জনিত রোগ এবং মনোরোগ বা মানুষিক রোগের মধ্যে তফাৎ ক্রমান্বয়েই কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীগণ এখন এই দুই ধরনের রোগের পেছনে প্রধানত একটি কারণই দেখতে পাচ্ছেন বলে দাবি করছেন এবং সে কারণটি হল বিপাক প্রক্রিয়া ভেঙ্গে পড়া এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ার কর্মক্ষমতা লোপ পাওয়া। 

মাইটোকন্ড্রিয়াকে বিপাকীয় দৃষ্টি থেকে আমরা শুধু কোষের শক্তি উৎপাদনের কারখানা বলেই জানতাম। কিন্তু সম্প্রতি জানা গেছে যে, মাইটোকন্ড্রিয়া আসলে কোষের মধ্যে আরও অনেকগুলো অতি জটিল কাজ/প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। এক কথায় বোঝাতে, হার্ভার্ড প্রফেসর ডাঃ ক্রিস পাল্মার তার বই "ব্রেইন এনার্জি" তে  একটি উদাহরণ ব্যবহার করেছেন। একটি কোষ কে যদি আমরা একটি কারখানার সাথে তুলনা করি, তাহলে মাইটোকন্ড্রিয়াগুলো হবে সেখানকার কারিগরগন। কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য কোথায় কি লাগবে, কখন লাগবে, কতটা লাগবে, কোথা থেকে তা জোগাড় করা যাবে ইত্যাদি সব বিষয়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকে মাইটোকন্ড্রিয়াগুলোর উপর। অর্থাৎ একটি কোষ সঠিকভাবে কাজ করবে যদি কোষের মাইটোকন্ড্রিয়াগুলো সঠিকভাবে কাজ করে। 

কিন্তু মনোরোগ তো মনের রোগ। সেখানে কোষ কিভাবে ভূমিকা রাখবে? চলুন তাই বোঝার চেষ্টা করি। মন হচ্ছে একটি অপার্থিব জিনিষ। অর্থাৎ মন কে ধরা, ছোঁওয়া, পরিমাপ করা, ওজন করা ইত্যাদি অসম্ভব। প্রতিটি মানুষ মনের অস্তিত্ব অনুভব করেন। সেটাই মনের অস্তিত্বের সব থেকে বড় প্রমাণ। মনের উপস্থিতিই আমাদেরকে মানুষ বানিয়েছে। অপার্থিব জিনিষ হলেও, মন কিন্তু আমাদের পার্থিব মস্তিষ্কের উপর নির্ভরশীল। এমন ঘটনা আমরা হরহামেশাই দেখি যে মাথায় (তথা মস্তিষ্কে) আঘাত পেলে, আহত মানুষটির স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয় অথবা কোন অঙ্গ পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন তিনি। একইরকমভাবে, মাথায় স্ট্রোক হলেও আমরা দেখি যে রোগীর এক পাশ অবশ হয়ে যায়। যখন মস্তিষ্ক কার্যক্ষমতা হারায়, তখন আমরা মানুষকে মৃত বলে ঘোষণা করি। 

মস্তিষ্ক ছাড়া দেহের অন্য যে কোন অঙ্গকে আমরা অস্ত্রপচারের মাধ্যমে বদলে নিতে পারি, কিন্তু তাতে মানুষটির মানবীয় গুণাবলিগুলো অপরিবর্তিত থাকে। অন্যদিকে মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করলে, স্মৃতিশক্তি, বোধ, চিন্তাশক্তি ইত্যাদি সব পরিবর্তিত হয়। এক কথায় মস্তিষ্ক হচ্ছে মনের আধার।  

জীবনে অসুস্থ্ হয়নি এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। আমাদের অসুস্থ্তার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সকলেই জানি যে, দেহ অসুস্থ্ হলে, মন খারাপ থাকে। কোন কিছু ভালো লাগে না। দেহ অসুস্থ্ হলে, তার প্রভাব আমাদের মস্তিষ্কের উপরেও পরে এবং ফলে আমাদের অনুভূতি প্রভাবিত হয়। আশা করি বুঝতে পারছেন যে, মনের সুস্থ্তা এবং স্বাভাবিকতার জন্য মস্তিষ্কের সুস্থ্তা অতি জরুরী। অর্থাৎ মস্তিষ্ক এবং মন আসলে অবিচ্ছেদ্য। 

এবারে চলুন বোঝার চেষ্টা করি যে কি করে বিপাকীয় স্বাস্থ্য আমাদের মনের উপর কিভাবে প্রভাব ফেলে। আমাদের দেহ এবং দেহের প্রতিটি অঙ্গ কোটি কোটি কোষ দিয়ে গঠিত। এই কোষগুলোর স্বাস্থ্য আমাদের অঙ্গগুলোর স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যেমন, কিডনির কোষগুলো অসুস্থ্য হলে, কিডনিটি অসুস্থ্য হয়ে পড়ে এবং তার কাজ তখন সঠিক ভাবে করতে পারে না। হৃদপিণ্ডের ক্ষেত্রেও আমরা একই ঘটনা দেখতে পাই। অর্থাৎ, কোন অঙ্গের কোষ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সে অঙ্গের 'কর্ম' ব্যাহত হয়। কোষ দুই উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যথা গঠনগত ক্ষতি হাওয়া এবং কোষের অভ্যন্তরে অঙ্গাণুর কর্মক্ষমতা নষ্ট হাওয়া।  

কোষের অভ্যন্তরের কাজগুলো করার জন্য শক্তি প্রয়োজন হয়। কোষের মধ্যকার মাইটোকন্ড্রিয়া সাধারণত খাবার হিসাবে গ্রহণ করা শর্করা (তথা চিনি বা গ্লুকোজ) বা চর্বি থেকে এই শক্তি উৎপাদন করে এবং এই শক্তির একক হল এটিপি। কোষের ভেতর কোন কারণে যদি এটিপি উৎপাদন হ্রাস পায়, তাহলে কোষ তার কাজ করতে পারে না। মস্তিষ্ক কোষের ভেতরে এমন এটিপি-র অভাব হলে তখন মস্তিষ্কের কাজ ব্যহত হয়।

এখানেই ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স বা ইনসুলিন বৈরিতা বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইনসুলিন বৈরিতা হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন দেহের কোন অঙ্গ বা কোন কলা (একই রকমের কোষ গুচ্ছ) ইন্সুলিনের সংকেত অগ্রাহ্য করে এবং পূর্বে তারা ইন্সুলিনের সংকেতে যে কাজ করত, সেই কাজ করা থেকে বিরত থাকে। দেহ যখন অনুভব করে যে কাঙ্ক্ষিত কাজটি সম্পন্ন হয়নি, তখন আরো বেশি ইনসুলিন দেহে ছড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ এই অবস্থায় দেহে অতি উচ্চ মাত্রায় ইনসুলিন উপস্থিত থাকে যারা সেই বিশেষ কাজের জন্য অক্ষম। বিষয়টি কে আরো জটিল করে তোলে যে কারণ, তা হলো, কোন বিশেষ কলা ইনসুলিন কে অগ্রাহ্য করলেও, দেহের অন্য অঙ্গ বা কলা কিন্তু অতিরিক্ত ইন্সুলিনের প্রভাবে তাদের কাজের গতি সমহারে বাড়িয়ে দেয়। যেমন দেহে চর্বি উৎপাদন এবং সংরক্ষণ এর গতি অনেক বেড়ে যায় এবং আমাদের ওজন বাড়তে থাকে; হাজারো ব্যায়াম করেও সে ওজন কমানো যায় না।

কিন্তু মস্তিষ্কের উপর ইনসুলিন কি করে প্রভাব ফেলে? এই প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের ইনসুলিন হরমোনের কাজ কে একটু বুঝতে হবে। ইন্সুলিনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে কোষের ভেতরে চিনি (গ্লুকোজ) প্রবেশ করার দরজা খুলে দেয়া। যেমন, শর্করা জাতীয় খাবার খেলে, হজমের পরে তা আমাদের রক্তে প্রবেশ করে এবং রক্তের চিনির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সাথে সাথে আমাদের প্যাঙ্ক্রিয়াস ইনসুলিন হরমোন নিঃসরণ করে এবং এর ফলে তিনটি ঘটনা ঘটে (যা আমাদের এই আলোচনার জন্য প্রযোজ্য), 

মস্তিষ্কের কোষ গুলো চিনি এবং চর্বি থেকে উৎপাদিত (যকৃতের মধ্যে) কিটোন নামের একটি উপাদান কে এটিপি উৎপাদনের জন্য ব্যাবহার করতে পারে। কিটোন আসলে দেহে চর্বি খরচ হওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে উৎপাদিত হয়। একজন সুস্থ্য মানুষ শর্করা খাওয়ার পরে তার চিনি বাড়বে যা ইনসুলিন নিঃসরণ ঘটাবে, যা চর্বি খরচ বন্ধ করে দেবে ফলে রক্তে কিটোনের মাত্রা কমে যাবে। অন্যদিকে, ইনসুলিন মস্তিষ্ক কোষের চিনির দরজা খুলে দেবে যেন চিনি ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। ফলে সেই চিনি ব্যবহার করে মস্তিষ্ক তার কাজ সম্পাদন করতে থাকবে। 

কিন্তু একজনের দেহ যদি ইনসুলিন বৈরী হয়, তাহলে খুব সাদামাটা ভাবে বুঝিয়ে বলতে গেলে, তার মস্তিষ্ক কোষ গুলোতে ইনসুলিন সংকেত কাজ করে না ফলে, মস্তিষ্ক গ্লুকোজের সাগরে ভেসে থাকলেও, সেই গ্লুকোজ কোষের ভেতরে নিতে পারে না। ইনসুলিন নিঃসরণের ফল হিসাবে অন্যদিকে আবার কিটোন উৎপাদনও থাকে বন্ধ। অর্থাৎ মস্তিষ্ক কিটোনও পায় না এবং চিনিকেও ব্যবহার করতে পারে না। ফলে, কোষ গুলো এটিপি অভাবে ভোগে এবং তাদের কর্মক্ষমতা ব্যহত হয়।

এই অবস্থাতেই রোগী বিভিন্ন মাত্রায় বিভিন্ন রকম মানসিক এবং নিউরলজিক অসুখের উপসর্গ অনুভব করেন। 

সমাধান কি? অতি সহজ সমাধান হচ্ছে ইনসুলিন কে না বাড়ানো এবং তা শুধু খাবার থেকে শর্করা বাদ দিলেই করা যায়। শর্করা না খেলে রক্তে চিনি বাড়ে না এবং ইনসুলিন হরমোন নিঃসরণ হয় না এবং চর্বি খরচ চলতে থাকে এবং কিটোন উৎপাদন চলতে থাকে যা মস্তিষ্ক ইন্সুলিনের সহযোগিতা ছাড়াই শুষে নিয়ে এটিপি উৎপাদনের কাজ চালিয়ে যায়। ফলে কোন কোন অসুখের উপসর্গ তক্ষুনি কমতে শুরু করে। কানাডার প্রফেসর স্টিভেন কুনেইন এর গবেষণায় তারা দেখেন যে আলঝেইমার্স রোগীকে 'কিটোন লবণ' খাইয়ে দিলে, কয়েক মিনিটের মধ্যে রোগীর আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সিটি স্ক্যানার ব্যাবহার করে তিনি রোগীদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখতে পান যে, পূর্বে মস্তিষ্কের যে অংশগুলোকে মৃত মনে করা হয়েছিল, সেই অংশগুলোও কিটোন ব্যাবহার করে শক্তি উৎপাদন করছে। ফলে রোগীগণ আগের দিন যে পরীক্ষাগুলোতে ফেল করেছিলেন, পরেরদিন কিটোন লবণ খাওয়ার পরে সেই একই পরীক্ষাতে তারা অনেক ভালো ফল দেখালেন।

কিভাবে কি হয়, সে নিয়ে তো অনেক কথা বলা হল। কিন্তু কিটো ডায়েট ব্যবহার করে আসলে মানসিক রোগীদের উপকার হয় এমন প্রমাণ কি আছে? অবশ্যই! নয়তো আপনাদের এত কথা বলবো কেন? হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকায়াট্রিস্ট (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) এবং প্রফেসর ডঃ ক্রিস্টফার পাল্মার, ডিউক ইউনিভারসিটির প্রফেসর ডঃ এরিক ওয়েস্টম্যান এই বিষয়ে কয়েকটি 'কেস স্টাডি' প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন জার্নালে। www.diagnosis-diet.com এর ডাঃ জর্জিয়া ঈড (আরেকজন হার্ভার্ড প্রশিক্ষিত মনোরোগ চিকিৎসক) এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তাঁর ওয়েবসাইটে। 

তবে এই গবেষণাটির বিবরণ শুনলে, আপনার বা আপনার আপনজনের মানসিক অসুখ সারিয়ে তোলার চেষ্টা হিসাবে আপনি নিশ্চিত যে আপনি কিটোজেনিক ডায়েট ব্যবহার করতে আগ্রহী হবেন। এই রইল ঠিকানাঃ https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/35873236/ 

ফ্রান্সের একটি মানসিক চিকিৎসার ক্লিনিকে ২৮ জন রোগীর উপর এই গবেষণা করা হয় যারা 'সিজোফ্রেনিয়া', 'বাইপোলার ডিসঅর্ডার', 'সিভিয়ার ডিপ্রেশন' ইত্যাদি অসুখে বহুদিন থেকে ভুগছিলেন। তাদের অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল যে  কোন ঔষধই তাদের কোন কাজে দিচ্ছিল না (ড্রাগ রিফ্র্যাক্টরি)। তাদের অসুখ বেড়ে গেলে তাদেরকে ক্লিনিকে এনে এক অর্থে বন্দি করে রাখা ছাড়া আর কোন চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছিল না। এই গবেষণার প্রধান অনুসন্ধানকারি, মনোরোগ চিকিৎসক ডাঃ অ্যালবারট ডানান, এই রোগীদের এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সেবা দিয়ে আসছিলেন। তিনি ভাবলেন, রোগীদের কিটো ডায়েট করিয়ে দেখবেন কোন উপকার হয় কিনা। কারণ এপিলেপ্সি রোগের অনেক ঔষধই মানসিক রোগ চিকিৎসায় ব্যাবহ্রিত হয় এবং সেই বিচারে কিটো ডায়েট তো গত একশত বছরেরও বেশি সময় ধরে মৃগী রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। তাহলে এই ডায়েট থেকেও মানসিক রোগের ক্ষেত্রে উপকার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে!  এবং ফলাফল যা পেলেন, তা অবিশ্বাস্য! ডাঃ জর্জিয়া ঈড এই গবেষণার ফল কে তার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি ছোট রচনায় এই ভাবে উপস্থাপন করেছেনঃ 

উৎসঃ https://www.diagnosisdiet.com/full-article/study-finds-serious-mental-illnesses-improve-on-ketogenic-diet

৪৩% রোগী তাদের মানসিক রোগ থেকে সেরে উঠেছেন যাদের আর কোন আশা ছিলই না! আশা করি কিটো ডায়েট এর শক্তির মাত্রা টা বুঝতে পারছেন এবারে। 

কিটো ডায়েট মানসিক রোগ চিকিৎসায় কিছু রোগীদের জন্য এত শক্তিশালী যে, ডায়েট ব্যবহারের সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ খাওয়া কমানোর দরকার হতে পারে। তাই আপনার চিকিৎসক কে জানিয়ে ডায়েট পরিবর্তন করবেন। কমপক্ষে ৩ মাস ব্যবহার না করে যথাযথ ফল আশা করা ঠিক হবে না।