ফ্যাটি লিভার
ফ্যাটি লিভার বা চর্বি মোড়া যকৃৎ রোগ কি, কিভাবে হয় এবং কিভাবে সারানো যায়?
ফ্যাটি লিভার বা চর্বি ঠাসা যকৃৎ অসুখটি একটি নীরব ঘাতক। প্রায় ৯০% যকৃৎ নষ্ট হবার আগে যেহেতু লিভার জনিত অসুখের কোন উপসর্গ দেখা দেয় না, তাই আমরা অনেকেই মনের সুখে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছি, যেমন খুশি খাচ্ছি অথচ জানতেও পারছি না যে আমাদের যকৃৎ ভয়ানক অসুস্থ্য! এরপরে যখন উপসর্গ দেখা দেয়, তখন আর সময় বাকি থাকে না, করার কিছু থাকে না! অবশ্যই আমরা কেউই সেখানে যেতে চাই না। আজকের আলোচনায় তাই আমরা জানব ফ্যাটি লিভার কি, কেন বা কেমন করে হয়, কি করে বুঝতে পারব যে ফ্যাটি লিভার হয়েছে এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, কিভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফ্যাটি লিভার কে চর্বিমুক্ত করে আবার সুস্থ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।
আমাদের দেহের রক্তে চিনি বেড়ে গেলে, সেই অতিরিক্ত চিনি কে চর্বিতে রূপান্তর করার সবথেকে বড় কারখানাটির নাম কি? ঠিক ধরেছেন, সেটি হল যকৃৎ বা কলিজা। চর্বি উৎপাদন যে অঙ্গটির একটি বড় কাজ, তার মধ্যে কিছু চর্বি উপস্থিত থাকা স্বাভাবিক। তাই সুস্থ্য একজনের কলিজায় সামান্য (৪% এর মতো) চর্বি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু কোন কারণে যদি তা বেড়ে ২০% এর আশেপাশে পৌঁছে যায়, তখন সেটা দুঃসংবাদ! তখন এই অবস্থাকেই বলা হয় চর্বিঠাসা যকৃৎ। যকৃতে চর্বি জমে গেলে যকৃৎ কোষ স্বাধীনভাবে পূর্ণ শক্তিতে কাজ করতে পারে না এবং যকৃতে প্রদাহ তৈরি হয়। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলতে থাকলে, এক সময় যকৃৎ সিরোসিসে আক্রান্ত হয় এবং তখন রোগীর জীবনে নেমে আসে মৃত্যুর কালো ছায়া, অন্ধকার!
চলুন এবারে বোঝার চেষ্টা করি যে এই সমস্যা কেন হয়। একাধিক কারণ রয়েছে এবং এই আলোচনায় আমরা দৃষ্টি দেব বিপাক কেন্দ্রিক কারণের দিকে। এই আলোচনায় আমরা ফ্যাটি লিভার অসুখের যে রূপটি এখন সব থেকে বেশি দেখা যাচ্ছে, তার কারণ কি, সেই দিকেই মনোযোগ দেব।
এই গল্পের খলনায়ক হচ্ছে এমন একটি কনা যা খেতে আমরা সকলেই খুব পছন্দ করি। মিষ্টি চিনি! বৈজ্ঞানিক নাম হল "ফ্রুক্টোজ"। আমরা দোকান থেকে যে চিনি কিনি, তার নাম হচ্ছে সুক্রোজ যার প্রতিটি অণু, একটি গ্লুকোজ এবং একটি ফ্রুক্টোজ অণু সমন্বয়ে গঠিত। তবে শুধু কেনা চিনিতেই নয়, বরং প্রকৃতিতে যেখানেই আমরা ফ্রুক্টোজ পাই, তার সাথে গ্লুকোজ থাকেই। অন্যকথায় মিষ্টি স্বাদের চিনি খেলেই আমরা গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ দুটোই খাচ্ছি।
গ্লুকোজ থেকে আমরা শক্তি উৎপাদন করতে পারি। আমাদের দেহের প্রায় প্রতিটি অঙ্গই গ্লুকোজ ব্যাবহার করে শক্তি উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু ফ্রুক্টোজ এর ক্ষেত্রে একমাত্র কলিজাই এই চিনি কে ব্যবহার করতে পারে, তাও আবার শক্তি উৎপাদনের জন্য নয়। দেহের চাহিদা থেকে বেশি চিনি আমরা খেয়ে নিলে, আমাদের দেহ সেই চিনিকে প্রধানত চর্বিতে রূপান্তর করে দেহে জমা রাখে। এই কাজে কলিজা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গ্লুকোজ বেশি খেয়ে নিলে যেহেতু সারা দেহ সেই গ্লুকোজ ব্যবহার করে, তাই কলিজার উপর কাজের ভার খুব বেশি পড়ে না। কিন্তু ফ্রুক্টোজ চিনি খেলে, পুরোটাই সামলাতে হয় কলিজা কে। এতে কলিজা প্রচুর চর্বি উৎপাদন করে। এতোটাই যে, সেই চর্বি যকৃৎ থেকে বেরিয়ে সারতে পারে না। ফলে যকৃৎ কোষের মধ্যে তা আটকে পড়ে। ফ্যটি লিভার অসুখের এই হচ্ছে কারণ।
এখন সারা দিনে যদি একবার/দুইবার এই ঘটনা ঘটতো, তাহলে কলিজা সামলে নিতে পারত। কিন্তু আধুনিক জীবনে আমরা খাবার এবং নাস্তা হিসাবে এতবেশি ফ্রুক্টোজ এতো ঘনঘন খাই যে, তা যকৃৎ থেকে বেড় হবার সুযোগই পায় না। ফলে চর্বি জমে যেতে থাকে।
যেমন ধরুন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা চিনি মেশানো পরিজ/সিরিয়াল খাই, কেউ রুটি বা ভাত খাই, কেউ আগের রাতের পিঠা বা ফিরনি খাই এবং রক্তে চিনির মাত্রা বাড়াই। এরপরে ১১টা নাগাদ আরেক দফা নাস্তা খাই যার মধ্যে থাকে বিস্কিট, কেক, মিষ্টি ফল ইত্যাদি। দুপুরের খাবারে খাই এত্তো এত্তো ভাত। অনেকেই জানিই না যে ভাত/রুটি/আলু হজমের পড়ে চিনি হয়ে রক্তে চিনির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কেউ হয়ত ভাবছেন, এই সামান্য দুই থালা ভাত খেলে কি এমন চিনি রক্তে ঢুকবে? মাত্র ১৫০গ্রাম ভাত খেলে, রক্তে চিনি বাড়তে পারে প্রায় ৯ চা চামচ পরিমাণ! ইউকে এর ডাক্তার ডেভিড আনউইন, আমাদেরকে ধারনা দেবার জন্য সেই হিসেব কষে রেখেছেন। এই লিংক এ গেলে আপনারা কোন খাবার খেলে কতটা চিনি বাড়তে পরে রক্তে, তা জানতে পারবেন। এর পরে বিকেলের নাস্তা, রাতের খাবার, টেলিভিশন দেখতে দেখতে চিপস বা মুরি খাওয়া এবং সব শেষে ঘুমাতে যাবার আগে আরেকবার একটু খেয়ে ঘুমাতে যাওয়া। প্রতিবার খাওয়া বা নাস্তা করার পর দেহের মধ্যে সেই খাবারের চিনির ব্যবস্থাপনা করতে কলিজার ৪-৬ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়। এবারে আপনি হিসাব করলে দেখতে পাবেন যে, এমনভাবে খেলে, আপনার কলিজা সারাদিন ধরে চিনিকে চর্বিতে রূপান্তর করে জমা করে। অর্থাৎ, চর্বির পরিমাণ বাড়তেই থাকে।
ইউ সি (সানফ্রানসিসকো) এর প্রফেসর ডাঃ রবার্ট লাস্টিগ আরও দেখিয়েছেন যে, ফ্রুক্টোজ চিনি খেলে, তা যকৃতের মধ্যে গ্লুকোজ তৈরির প্রক্রিয়াকে চালু করে রাখে, যদিও দেহে প্রয়োজনের বেশি গ্লুকোজ রয়েছে। এই অতিরিক্ত গ্লুকোজও আবার চর্বি আকারে দেহে জমা পড়ে। নতুন চর্বি উৎপাদনে তা ভূমিকা রাখে।
এদিকে কলিজায় চর্বি জমলে, কলিজার কোষগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে রক্তের চিনি সরিয়ে নিতে সময় বেশি লাগে। রক্তে চিনি বেড়ে থাকলে, অতিরিক্ত ইন্সুলিন নিঃসরণ হয় এবং চিনি থেকে চর্বি উৎপাদনের গতি অনেক বেড়ে যায়। ফলে, কলিজায় আরো বেশি চর্বি জমতে থাকে।
আশাকরি কলিজায় চর্বি কেন জমে যায়, সে বিষয়টি এখন বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু আপনার কলিজায় চর্বি জমা আছে কিনা, কি করে বুঝবেন? আল্ট্রাসনগ্রাফি করে দেখা যেতে পারে যে কলিজায় চর্বি কতটুকু আছে। এই উপায় আপনাকে একদম সঠিক তথ্য দেবে। কিন্তু এই উপায় অনেকের জন্যেই ব্যয়বহুল হতে পারে।
এর থেকে কম খরচে যে পরীক্ষা করে ফ্যাটি লিভার বোঝা যায়, তা হল ALT (SGPT) নামের একটি পরীক্ষা করা। এই পরীক্ষায় যদি ২০ এর বেশি মান পাওয়া যায়, তাহলে ফ্যাটি লিভার সন্দেহ করা সঙ্গত হবে। বর্তমানে ল্যাবরেটরিগুলোতে এ এল টি যদি ৪০ এর কম থাকে, তাহলেও তাকে স্বাভাবিক বলা হয়। প্রফেসর রবার্ট লাস্টিগ এ বিষয়ে বললেন যে, ২০ বছর আগে, স্বাভাবিকের উচ্চ মাত্রা ছিল ২৫। কিন্তু এখন প্রায় সকলেরই যেহেতু ফ্যাটি লিভার আছে, তাই গড় খানিকটা সামনে এগিয়ে গিয়েছে।
৩য় যে পরীক্ষাটির ফল থেকে ফ্যাটি লিভার সন্দেহ করা যায়, তা হল ১২-১৪ ঘণ্টা উপোষ করার পরে রক্ত দিয়ে লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করলে যদি ট্রাইগ্লিসারাইড এইচ ডি এল এর তুলনায় দ্বিগুণ বা তার বেশি হয়, তাহলে ফ্যাটি লিভার আছে বলে সন্দেহ করা যায়।
কিন্তু ল্যাবরেটরিতে না গিয়েও আমরা ফ্যাটি লিভার থাকার সম্ভাবনা চিহ্নিত করতে পারি। যাদের ফ্যাটি লিভার থাকে, তাদের
১। কিছুদিনের মধ্যেই ওজন বেড়ে যায় এবং বাড়তেই থাকে
২। ভুরি বেরিয়ে যায় (নাভি বরাবর কোমরের মাপ, উচ্চতার অর্ধেকেরও বেশি হয়)
৩। কুচকি, বগল বা ঘাড়ে খসখসে কালো চামড়া দেখা যায়
৪। ঘাড়ে, বগলে, কুঁচকিতে, চোখের পাতায় ছোট ছোট আঁচিল দেখা দেয়
৫। মুখে ব্রণ দেখা দেয়
৬। পুরুষদের পৌরুষ শক্তি কমে যায় এবং মহিলাদের জরায়ুতে গোটা/দানা দেখা দেয়
৭। উচ্চ রক্তচাপ বা ২য় ধরনের ডায়বেটিস থাকলে নিশ্চিত জানবেন যে আপনার কলিজায় চর্বি রয়েছে
ইত্যাদি।
এবারে চলুন বোঝার চেষ্টা করি যে কি করে কলিজার চর্বি কমানো যাবে এবং কলিজাকে সুস্থ্য করে তোলা যাবে।
প্রফেসর লাস্টিগ ফ্যাটি লিভার আক্রান্ত শিশুদের উপর একটি গবেষণায় পর্যবেক্ষণ করেন যে, শিশুদের খাবার থেকে শুধু মিষ্টি চিনি সরিয়ে নিয়ে, তার সমান বা তার থেকে বেশি ক্যালরি সম্পন্ন গ্লুকোজ দিলেও, মাত্র ৯ দিনে তাদের কলিজার চর্বি গড়ে ৩০% কমে যায়। এই রচনাটিতে উক্ত গবেষণাটি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
তাহলে প্রথম যেই পরিবর্তনটি করতে হবে, আশা করি সেটি সকলে বুঝে গিয়েছেন। জ্বি হ্যাঁ, আপনার খাবার থেকে মিষ্টি চিনি একদম বাদ দিতে হবে।কোমল পানীয়, ফলের রস, সরবত ইত্যাদি সব খাওয়া নিষিদ্ধ। সাথে গ্লুকোজ সমৃদ্ধ (বা শর্করা জাতীয়) খাবার খাওয়া কমাতে হবে। মিষ্টি স্বাদযুক্ত কোন খাবারই খাওয়া যাবে না। মাছ, মাংশ, ডিম এবং সবুজ শাকসবজি বেশি করে খাবেন।
আর কি করবেন? ঘন ঘন খাবেন না। কালো চা বা কফি খেতে পারেন কিন্তু সাথে বিস্কুট, মুরি, চানাচুর, পুরি, সিঙ্গারা, সমোচা ইত্যাদি সব নিষিদ্ধ।
সকাল বেলায় অনেকেই আমরা অভ্যাসবশে নাস্তা খাই যদিও আমাদের ক্ষুধা থাকে না। এই অভ্যাসের পরিবর্তে যদি আমরা সকালে নাস্তা খাওয়া বাদ দেই বা আরো দেরি করে নাস্তা করি, তাহলে দেহ আরও কিছু বেশি চর্বি পোড়াবার সময় এবং সুযোগ পায়। আমাদের সৌভাগ্য যে কলিজার চর্বিই আমাদের দেহ প্রথমে খরচ করে শেষ করে। অর্থাৎ, দ্রুত কলিজাকে চর্বি মুক্ত করতে চাইলে, সকালে নাস্তা খাওয়াটাও বন্ধ রাখলে ভাল হবে।
সুস্বাদু এবং মিষ্টি খাবার খেতে যারা ভালবাসেন, তারা হয়ত ভাবছেন যে তাহলে বেঁচে থেকে লাভ কি? মজার সব খাবারই যদি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে আর আনন্দ থাকে কোথায়? তাদের জন্যে খুব খুশির কোন খবর বিজ্ঞানের হাতে নেই এখনো। তবে কিছু চালাকি করা যায়। যেমন ধরুন, ঠিকঠাক নিয়ম মেনে যদি আপনার কলিজা চর্বিমুক্ত হয়ে যায়, তাহলে তখন আবার মজার খাবারগুলো মাঝে মাঝে অল্প পরিমাণে খেতে পারবেন। অর্থাৎ জীবনটা একেবারেই মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে না। অন্য যে কাজটি করতে পারেন, তা হল, পছন্দের খাবারগুলোকে আপনি যে দুইবেলা খাবেন, সেই খাবারের সাথে সাথে খেয়ে নেয়া। যেমন দুপুরের খাবার খাওয়ার পরে আপনার পছন্দের খাবার (যা অন্য সময় খাওয়া নিষেধ) একটু খেয়ে নিতে পারেন। অবশ্যই এতে কলিজার চর্বি কমতে সময় বেশি লাগবে, কিন্তু কেউ কেউ হয়ত পছন্দের খাবার একেবারেই না খেতে পারলে, কলিজা ভাল করার দরকার নেই বলে, নিজের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারেন।
যারা ডায়বেটিস (২য় ধরন) বা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন এবং এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইন্সুলিন বা রক্তচাপ কমাবার ঔষধ ব্যাবহার করেন, তাদের অবশ্যই সাবধান হতে হবে। কলিজার চর্বি কমানোর এই পদ্ধতি আপনার রক্তের চিনি এবং উচ্চ রক্তচাপ কে অতি দ্রুত স্বাভাবিক মাত্রার দিকে ফিরিয়ে আনবে। তাই এই অভ্যাসের সাথে সাথে ঔষধ এর পরিমাণ না কমালে বা খাওয়া বন্ধ না করলে, সাংঘাতিক বিপদে পড়তে পারেন। এমন রোগীগণ একজন চিকিৎসকের তত্বাবধানে থেকে এই অভ্যাস করতে পারেন। রক্তচাপ এবং রক্তে চিনির মাত্রা পরিমাপ করার যন্ত্র থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ এমন রোগীদের ক্ষেত্রে।
কেমন হবে আপনার খাদ্যাভ্যাস? ডাঃ ডেভিড আনউইন তার রোগীদের জন্য যে খাদ্যতালিকা তৈরি করেছেন, আপনারা সেটা ব্যবহার করতে পারেন। সেটিকে পাওয়া যাবে এইখানে ক্লিক করলে।
এভাবে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রায় সকলেই তাদের ফ্যাটি লিভার কে সুস্থ্য করে তুলতে পারেন।