বিপাকীয় অসুখ

বিপাক হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জীবকোষ এটিপি নামক শক্তি উৎপাদন করে। এই প্রক্রিয়া কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া নামক যে অঙ্গাণু থাকে, তার মধ্যে সংঘটিত হয়। সহজে বোঝার জন্য মাইটোকন্ড্রিয়াকে একটি রান্নার চুলা এর সাথে তুলনা করা যায়। চুলায় যেমন আমরা কাঠ-খর বা গ্যাস পুড়িয়ে তাপ উৎপাদন করি এবং সেই তাপে রান্না করি, মাইটোকন্ড্রিয়াও তেমনি, খাবারের গ্লুকোজ বা চর্বি রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভেঙ্গে এটিপি নামক শক্তি কনা উৎপাদন করে যা কোষের ভেতরে জৈবিক ক্রিয়াকলাপের জন্য ব্যবহৃত হয়। 

বিপাকীয় স্বাস্থ্যকে রক্ষা করতে চাইলে, বিপাকীয়ে স্বাস্থ্য কেন ভেঙ্গে পড়ে, তা বোঝা খুব দরকার। সব ক্ষেত্রে নয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিচে দেয়া গল্পটি আমাদের জীবনে সত্য প্রমাণিত হয়। এই গল্পের শুরু হচ্ছে চিনি নামের মিষ্টি স্বাদের একটি কনাকে দিয়ে। চিনি যা আমরা বাজার থেকে কিনে আনি, বা ফলের মধ্যে যে চিনি থাকে, তাঁর নাম হল ফ্রুক্টজ। এই চিনি আমাদের কলিজাতেই শুধুমাত্র প্রক্রিয়াজাত হতে পারে। গ্লুকোজকে গ্লাইকজেন আকারে আমাদের দেহ জমা রাখতে পারে, কিন্তু ফ্রুক্টজের ক্ষেত্রে তা হয় না। ফলে যতটুকু ফ্রুক্টোজ চিনি আমরা খাই, তাঁর পুরটাই কলিজায় চর্বি আকারে জমা হয় এবং নন এলকহলিক ফ্যাটি লিভার অসুখটি দেখা দেয়। লিভারে চর্বি বেশী জমে গেলে, লিভারের কোষগুলোর কাজে ব্যঘাত হয় এবং তারা ইন্সুলিন হরমোনের প্রভাবে আর আগের মত কাজ করে না। অন্য কথায়, ইন্সুলিন হরমোন তাঁর কার্যকারিতা হারায়। বিষয়টি সমাধান করার জন্য, অগ্নাশয় আরও বেশী ইন্সুলিন উৎপাদন করে রক্তে মিশিয়ে দেয়। ইনসুলিন যেহেতু আমাদের দেহের প্রতিটি কোষের উপর প্রভাব ফেলে, এই অতিরিক্ত ইন্সুলিনের উপস্থিতি সমস্ত দেহ কে ভারসাম্যহীনতার দিকে ঠেলে দেয়। এই অবস্থা কিছুদিন ধরে চলতে থাকলে, আমাদের দেহের অন্য অঙ্গগুলোও ইন্সুলিন হরমোনের সঙ্কেতে আর আগের মত কাজ করে না। এই অবস্থায় স্বাভাবিক মাত্রার ইন্সুলিন দিয়ে, খাওয়ার পরে রক্তে যে চিনি বাড়ে, সেই চিনি কে রক্ত থেকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। এই অবস্থাটি কে বলা হয় ইন্সুলিন বৈরিতা বা ইন্সুলিন রেসিস্ট্যান্স। এর সমাধানের জন্য আমাদের অগ্নাশয় ক্রমবর্ধমান মাত্রায় ইন্সুলিন উৎপাদন করে, যা সাময়িকভাবে রক্ত থেকে চিনি সরিয়ে নিতে পারলেও,  ইন্সুলিন বৈরিতা আরও বাড়িয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়া ১০ বা ১৫ বছর ধরে চলার পরে এমন একটা অবস্থা আসে যখন, আমাদের অগ্নাশয় স্বাভাবিক মাত্রা থেকে ৭ থেকে ১০ গুন ইন্সুলিন উৎপাদন করলেও, তা রক্তের চিনির সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারে না। তখনই রক্তের চিনি পরীক্ষা করে ডাক্তার আমাদের বলেন যে আমাদের ডায়বেটিস হয়েছে। 

দুটি রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আপনি ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স পরিমাপ করতে পারবেন। প্রথম পরীক্ষাটি হচ্ছে 'উপোষ  অবস্থ্যয় রক্তে ইনসুলিন হরমোনের মাত্রা পরিমাপ করা। ১২ ঘণ্টা উপোষ করার পরেও যদি আপনার দেহে অতিরিক্ত ইনসুলিন উপস্থিত থাকে, তাহলে বোঝা যায় যে আপনার দেহ স্বাভাবিক ভাবে কাজ করছে না। যাদের সম্প্রতি ২য় ধরনের ডায়বেটিস ধরা পড়েছে, তাদের জন্য এই পরীক্ষাটি অতি মূল্যবান। এই পরীক্ষা প্রমাণ করে যে তাদের অগ্নাশয় আসলে সক্রিয় আছে এবং তাদের অসুখটি ইনসুলিনের অভাব জনিত রোগ নয়। প্রচলিতভাবে ডাক্তারগণ ২য় ধরনের ডায়বেটিস রোগীকে যেহেতু ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন নিতে বলেন, কেননা তারা দাবি করেন যে দেহে ইনসুলিন উৎপাদন হচ্ছে না, এই পরীক্ষার ফল দেখলে, তারা সেই ভুল করা থেকে বিরত থাকতে পারবেন। 

অন্য যে পরীক্ষাটি ব্যবহার করা যায়, তার নাম হচ্ছে 'লিপিড প্রোফাইল' টেস্ট। এ ক্ষেত্রে TG/HDL অনুপাত ১.৫ এর বেশি হলেই সাবধান হতে হবে। আর যদি এই অনুপাত ২.০ এর বেশি হয়, তাহলে আপনার এখুনি ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। 

সমাধান অবশ্য খুব সহজ। খুব পুরাতন রোগ না হলে, অনেক ক্ষেত্রে ঔষধ ছাড়াই ইনসুলিন বৈরিতা সারিয়ে ফেলা যায়।