ক্যান্সার ও মানসিক চাপ

ক্যান্সার রোগ ধরা পড়লে মানসিক চাপের ব্যবস্থাপনা

(মোঃ শাহাদাৎ হোসেন, স্বাস্থ্যশিক্ষক) 


ক্যান্সার একটি মারাত্মক জীবনঘাতী অসুখ। নতুন নতুন চিকিৎসা এবং ঔষধ আবিষ্কার হবার পরেও ক্যান্সার জনিত কারণে মৃত্যুর হার ক্রমে বেড়েই চলেছে।পৃথিবীর অনেকগুলো দেশেই এখন ক্যান্সার হচ্ছে মানব মৃত্যুর ২য় বৃহত্তম কারণ এবং অল্প কিছু দেশে এটি প্রথম স্থান দখল করে বসে আছে। 


এই অবস্থা কে আরো ভীতিকর করে তুলেছে আশঙ্কাজনক হারে নতুন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। আমরা সকলেই ক্যান্সার আক্রান্ত এক বা একাধিক মানুষকে চিনি বা জানি।


সুতরাং ক্যান্সার আক্রান্ত হলে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে।


প্রচলিত ক্যান্সার চিকিৎসায় রোগীর যেহেতু চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে ঔষধ গ্রহণ করা ব্যতীত করনীয় কিছু বিশেষ থাকে না, তাই রোগীর মানসিক অবস্থা তার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব ফেলে না। মানসিকভাবে শক্ত থাকলেও যে কিমো থেরাপি দেয়া হবে, ভেঙ্গে পড়লেও এই একই থেরাপি দেয়া হবে।


রোগীর জীবনের গুনগত মানের ক্ষেত্রে অবশ্য মনের জোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে রোগী যখন দৈহিক ভাবে খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যান, মানসিক শক্তি কম হলে, তখন সেই কষ্ট আরো বেশি অনুভূত হয়। বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছে সাম্প্রতিক কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। হার্ভার্ড প্রফেসর এবং সাইকায়াট্রিস্ট ডাঃ ক্রিস পাল্মার, যিনি সম্প্রতি 'ব্রেইন এনার্জি' নামে একটি বই লিখেছেন, তিনি দাবি করছেন যে মানসিক স্বাস্থ্য এবং দৈহিক স্বাস্থ্য আসলে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। আপনার দেহ যদি সুস্থ্ না থাকে, বিপাক যদি ব্যাহত হয়, তাহলে আপনার মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করবে না। মন যেহেতু মস্তিষ্কের কোষ গুলোর মধ্যে তথ্য আদানপ্রদানের ফল, মস্তিষ্ক সুস্থ না থাকলে মানসিকভাবে সুস্থ থাকা অসম্ভব বলে তিনি দাবি করছেন। 


আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও এই দাবির সত্যতা দেখতে পাই। কোন কারণে শরীর খারাপ হলে, সাথে সাথে মানসিকভাবেও আমরা দুর্বল অনুভব করি। একইভাবে, সুস্থ্য সবল মানুষ হঠাৎ কোন খারাপ খবর পেলে, সাথে সাথেই আমাদের দেহ দুর্বল হয়ে পড়ে। মানসিক চাপ বা স্ট্রেস যে আমাদের কোষের অভ্যন্তরে বিপাক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়, সেই বিষয়ে তো বহুদিন আগে থেকেই আমাদের জানা আছে। 


ক্যান্সার রোগ সম্পর্কে নতুন যে ধারনা বা তত্ব জনপ্রিয়তা লাভ করছে, যে তত্ব ক্যান্সার রোগের কারণ হিসাবে কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ায় বিপাকজনিত ত্রুটিকে চিহ্নিত করছে, তার বিচারে অবশ্য রোগীর মানসিক শক্তি তার রোগমুক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে বিজ্ঞানীগণ একমত যে যদি আমরা মানসিক চাপের মধ্যে থাকি, তাহলে আমাদের দেহে গ্লুকোজের উৎপাদন বেড়ে যায় এবং রক্তে গ্লুকোজ মাত্রা বেড়ে যায়। এদিকে ক্যান্সারের নতুন তত্বমতে, ক্যান্সার কোষ প্রধানত গ্লুকোজ খেয়ে বাঁচে এবং স্বাভাবিক কোষ থেকে ৪০০ গুন পর্যন্ত বেশি গ্লুকোজ খেতে পারে। অর্থাৎ রক্তে গ্লুকোজ বেশি থাকলে, ক্যান্সার বেশি খাবার পায় এবং দ্রুত বড় হতে থাকে। মন কে চাপ মুক্ত রাখা গেলে, রোগীর দেহ ক্যান্সার কোষের জন্য খাবার তৈরি করা থেকে বিরত থাকে। 


কিন্তু মন তো আমাদের ইচ্ছাধীন নয় এবং তাই চাইলেই মানসিক চাপ কমিয়ে ফেলা যায় না। তবে এ বিষয়ে কিছুই করা যাবেনা, সেটাও ঠিক নয়। আমরা আমাদের কাজের মাধ্যমে আমাদের মনোযোগকে ঘুরিয়ে দিতে পারি এবং যদি এমন কিছু নিয়ে ব্যস্ত হই যা আমাদের প্রিয় বা উপভোগ্য, তখন মানসিক চাপ কমে আসে। খেলাধুলা বা ব্যায়াম করা সেই কারণেই আমাদের মন ভালো করতেও ভূমিকা রাখে।


ক্যান্সার রোগ ধরা পড়লে মানসিক চাপ সৃষ্টি হবার পেছনে সব থেকে বড় কারণটি হল এই রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার। জ্বর সর্দি বা ভাইরাস আক্রান্ত হলে আমরা তেমন মানসিক চাপ অনুভব করি না কারণ এক্ষেত্রে মৃত্যু ভয় অনেক কম। একথা সত্য যে ক্যান্সার আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি, তাই মানসিক চাপ হবেই, আবার সেই চাপের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি আরো বাড়বে! এক সর্বনাশা চক্র! 


তবে ক্যান্সারের নতুন যে তত্বের কথা একটু আগেই আমরা বলছিলাম, সেই তত্বের আলোকে আমরা রোগীকে হতাশার এই চক্র থেকে বের করে আনতে পারি। আজ থেকে শত বছর আগে ১৯২০ এর দশকে নোবেল বিজয়ী জার্মান বিজ্ঞানী অট্ট ওয়ারবারগ আবিষ্কার করেছিলেন যে ক্যান্সার কোষ প্রধানত গ্লুকোজ খেয়ে বাঁচে এবং চর্বি বা চর্বি থেকে পাওয়া কোন পুষ্টি কনা কে শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যাবহার করতে পারে না। করনীয় হল, ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া। অর্থাৎ রোগী যদি শর্করা, যা আসলে গ্লুকোজের লম্বা শিকল, খাওয়া বন্ধ করেন, এবং তার পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর চর্বি বেশি করে খান, তাহলে দেহে এমন অবস্থা তৈরি হয় যা সুস্থ্য অঙ্গকে সুরক্ষা দেয়, দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কে শক্তিশালী করে এবং ক্যান্সার কোষকে দুর্বল করে দেয়। 


হাজার হাজার রোগী এই উপায়ে তাদের ক্যান্সার কে নিয়ন্ত্রণ করে অথবা ক্যান্সার মুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে আছেন। অর্থাৎ, ক্যান্সার হলে আমাদের অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনাই বেশি - কথাটি এখন আর সঠিক নয়। নতুন এই তত্বের আলোকে ক্যান্সার গবেষকগণ বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন এবং এপর্যন্ত আশাব্যাঞ্জক ফলাফলই দেখা যাচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে "Feasibility and metabolic outcomes of a well-formulated ketogenic diet as an adjuvant therapeutic intervention for women with stage IV metastatic breast cancer: The Keto-CARE trial" (https://journals.plos.org/plosone/article?id=10.1371/journal.pone.0296523 ) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর কথা বলা যায়। ২০২৪ সালে প্রকাশিত এই গবেষণায় স্টেজ ৪ মেটাস্ট্যাটিক স্তন ক্যান্সার রোগী, যাদের ক্ষেত্রে প্রচলিত চিকিৎসায় আর কিছু করার ছিল না এবং চিকিৎসকগণ তাদের আয়ুষ্কাল বেধে দিয়েছিলেন খুব বেশি হলে ১ বছর, তাদের কে ৬ মাস ধরে কিটোজেনিক (অন্য কথায় শর্করামুক্ত) খাদ্যাভ্যাস করানো হয়। উপরোল্লিখিত প্রকাশনায় তারা প্রমাণ দিয়েছেন যে এই অভ্যাস রোগীদের কোন ক্ষতি করেনি এবং এই খাদ্যাভ্যাস এমন অগ্রসর পর্যায়ের ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রেও নিরাপদ। এই গবেষণা বিষয়ে একটি আলোচনায়, গবেষকদের একজন, প্রফেসর ডেভিড হারপার বলেন যে, এই গবেষণায় অংশ নেয়া প্রতিটি রোগী এই ডায়েট ব্যবহার করে তাদের ক্যান্সার কে দুর্বল করে ফেলতে পেরেছিলেন। এবং আরও আশার কথা হল, কয়েকজন রোগীর দেহে গবেষণার শেষে আর ক্যান্সার টিউমার খুঁজেই পাওয়া যায়নি! 


শর্করা বর্জিত এই খাদ্যাভ্যাস যেহেতু অনেক মুখরোচক খাবার কে নিষিদ্ধ করে দেয়, সেকারণে অনেকে এই ডায়েট পছন্দ করেন না। কিন্তু একজন ক্যান্সার রোগী যখন প্রাণ বাঁচাতে ভয়ানক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জেনেও কিমোথেরাপি নিতে প্রস্তুত থাকেন, তার জন্য শুধু মুখরোচক খাবার না খেতে পাওয়া খুব বড় বাধা নয় মনে করেন ক্যান্সার গবেষক প্রফেসর ডঃ টমাস সেয়ফ্রিড।


এক কথায়, ক্যান্সার জটিল অসুখ বটে, কিন্তু আশার কথা হল, ক্যান্সার কে নিয়ন্ত্রণ করা এখন অসম্ভব নয় এবং বরং একরকম সহজই বলা চলে। এই কথা জানা থাকলে, রোগীগনের মানসিক চাপ কমে যাবার কথা। 


তবে রোগীকে তার অসুখের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিতে হবে। তাকে ক্যান্সার অসুখ কি এবং কি করে হয়, তা বুঝতে হবে। কোন খাবার কি করে তার ক্যান্সারের পক্ষে বা বিপক্ষে কাজ করে তা বুঝতে হবে। খাদ্যাভ্যাস থেকে অনেক মুখরোচক খাবার বাদ দিতে হবে, রোজা এবং/অথবা উপোষ করতে হবে, মাস ব্যাপী খাবার ছাড়া কাটাতে হতে পারে, কিমো বা রেডিয়েশন থেরাপির সময় ৩দিন ব্যাপী উপোষ করতে হতে পারে, ব্যায়াম করতে হবে, উপভোগ্য কাজে অংশ নিতে হবে, যোগাসন এবং ধ্যান করতে হতে পারে ইত্যাদি। সহজ নয় অবশ্যই, কিন্তু ক্যান্সার অসুখটাও তো সহজ নয়, তাই না? 


 আরেকটি ঘটনা প্রায় সব ক্যান্সার রোগীর মধ্যেই ঘটতে দেখা যায় এবং তা হল ক্যান্সার হবার ঘটনাটি মেনে নিতে না পারা। এত মানুষ থাকতে তারই কেন ক্যান্সার হল? এমন অবস্থায় মনের মধ্যে ঝড় চলতে থাকে, চাপ বেড়ে থাকে যা রোগীর ভবিষ্যতকে আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। মৃত্যুর ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে ফেলে। কিন্তু এর থেকে মুক্তির উপায় কি?


স্বভাবগতভাবে, মানুষ নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাশালী মনে করে। আমাদের ব্যক্তিগত চেতনার মাধ্যমেই যেহেতু আমরা জগতকে বিচার করি, তাই আমাদের কাছে আমিত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমন একজন মানুষ যখন ক্যান্সার আক্রান্ত হন এবং হঠাৎ অনুভব করেন যে, তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার নিজের জীবনের উপরই নিয়ন্ত্রণ নেই তার! মেনে নিতে পারেন না। 


এমতাবস্থায়, রোগীকে যদি বোঝানো যায় যে প্রতিটি মানুষই আসলে এই সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ, তাহলে সে কিছুটা অনুভব করে যে সে একা নয়। অদৃষ্টের এই বাধন কে বুঝতে পারলে, মানুষের মন যেন ভারমুক্ত হয়।  


এই সময় ইসলামের ভাগ্যের ধারনা, যেখানে বলা হয় যে, 'ভাগ্যের ভালো মন্দ উভয়ই আল্লাহর তরফ থেকে আসে' ধারনাটি রোগীকে বোঝানো গেলে সে হয়তো অনুভব করতে পারে যে, তার অবস্থার জন্য সে নিজে সম্পূর্ণ দায়ী নয়। নিজেকে দোষারোপ করার প্রবণতা খানিক কমতে পারে যদি সে বোঝে যে অতীতে যা কিছুই ঘটেছে, সেটা নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ যে, অতীতের ঘটনাগুলো অন্যভাবে হবার কোনই সুযোগ ছিল না। নিজের ভুল ত্রুটি গুলোর জন্য নিজেকে ক্ষমা করা সহজ হয়। 


একই নিয়ম মেনে, ভবিষ্যতের ঘটনাগুলো সম্পর্কে তার থাকবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। ভবিষ্যতের প্রতিটি ঘটনা ঘটার ক্ষেত্রে যেহেতু তার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে এবং আল্লাহ যে কোন একটি অবস্থায় তার জন্য কি নির্ধারণ করে রেখেছেন, তা যেহেতু অজানা, তাই তার চেষ্টা হবে প্রতিটি মুহূর্ত ইতিবাচক কাজ ও ভাবনায় ডুবে থাকা। চিকিৎসার ক্ষেত্রে এমন মনোভাব ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।


একথা ঠিক যে অসুখ ধরা পরার ঠিক পরপর এই কথাগুলো বোঝা কঠিন হবে। মন খুব অস্থির থাকবে এবং শত বোঝালেও, নেতিবাচক ভাবনা গুলো বারবার মনের মধ্যে বুদবুদের মতো ভেসে উঠতে থাকবে। তবে সময়ের সাথে সাথে এই অস্থিরতা স্থিমিত হয়ে আসবে এবং তখন নিজেকে একটি বিশাল জগতের একটি বিন্দু হিসাবে বিবেচনা করলে এবং বুঝলে যে, এই বিশাল জগত আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, তখন নিজের দিকে মনোযোগ দেয়া সহজ হবে। আল্লাহ্‌র ইচ্ছার প্রতি আত্মসমর্পণ করে প্রতিটি মুহূর্ত কে নিজের পছন্দের কাজ দিয়ে সাজিয়ে নেয়া সহজ হবে। ক্যান্সার কে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, নতুন সে জীবন হবে অনেক বেশি সার্থক!