ক্যান্সার

 মনে রাখতে হবে যে, ক্যান্সার প্রধানত গ্লুকোজ খেয়েই বাঁচে

ক্যান্সার রোগীদের স্বার্থে আমরা একটি ফেসবুক গ্রুপ পরিচালনা করছি, আপনিও আজই যোগ দিনঃ ক্যান্সার ডায়েট থেরাপি গ্রুপ 

ক্যান্সার রোগীদের প্রফেসর ডঃ টমাস সিফ্রিড এর গবেষণা সম্পর্কে জানা অতি জরুরি যদি তারা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই তাদের রোগ নিয়ন্ত্রণ  করা শিখতে চান।

প্রফেসর সেফ্রিড  EasyHealthEducation.com এর প্রতিষ্ঠাতা শাহাদাৎ কে যে শিক্ষামূলক তথ্য ইমেইল করে পাঠিয়েছেন, তা দেখতে এখানে ক্লিক করুন। 

সূচনাঃ

ক্যান্সার একটি প্রাণঘাতী অসুখ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতির পরেও এই অসুখটি সম্পর্কে আমরা খুবই অল্প জানি; যে কথাটি নিশ্চিতভাবে জানি, তা হল, এটি পৃথিবীজুড়ে মানব মৃত্যুর ৩য় বৃহত্তম কারন এবং অনেক দেশেই এখন এই অসুখ ২য় বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ হিসাবে স্বীকৃত।  আরও ভাবনার কথা হচ্ছে, এই সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তাই এই অসুখ সম্পর্কে বোঝা এবং প্রতিরোধের জন্য সচেষ্ট হওয়া খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। 

সারসংক্ষেপঃ 

এই সংক্ষিপ্ত রচনায় আমরা প্রফেসর টমাস সেয়ফ্রিড, প্রফেসর ডমিনিক ড্যাগস্টিনো, প্রফেসর ডেভিড হারপার, ডাঃ জেসন ফাং, ডাঃ কেন বেরি, ডাঃ ক্রিস্টি কেস্লারিং, ডাঃ নাশা উইন্টারস, ডাঃ ম্যাথিউ ফিলিপ্স প্রমুখ প্রচারিত ক্যান্সারের মেটাবলিক তত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যারা কোন কারণে বিস্তারিত পড়তে অসমর্থ, ক্যান্সার হলে তাদের কি কি করলে উপকার হবার কথা, তাই এখানে সংক্ষিপ্তরূপে উল্লেখ করছিঃ
১। ক্যান্সার কোষ তথা টিউমার প্রধানত গ্লুকোজ খেয়ে বাঁচে। তাই আমাদের খাবার থেকে গ্লুকোজ বাদ দিলে উপকার হবার কথা।  এই  কাজটি  সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
২। প্রতিবার খাওয়ার পরে দেহে ইন্সুলিন হরমোন নিঃসৃত হয়। ইন্সুলিন ক্যান্সার কোষকে বড় হতে সংকেত দেয়। তাই ঘন ঘন খাওয়া যাবে না।
৩। দিনে ১৮ ঘণ্টা উপোষ (রাত ৮টা থেকে দুপুর ২টা) করলে এবং বাকি ৬ ঘণ্টার মধ্যে দুই বেলা খেলে এবং মাঝে কোন নাস্তা না খেলে, উপরের দুটো উপকার পাওয়া যায় এবং সাথে সাথে দেহের সুস্থ্য কোষের মধ্যে অটোফেজি (কোষের ভেতরের আবর্জনা পরিষ্কার করা) এবং সারা দেহে অটোলিটিক ক্যানাবলিজম (অপ্রয়োজনীয় কোষ বা কলা কে ভেঙ্গে সরিয়ে ফেলা) শুরু হয়। তাতেও ক্যান্সার টিউমার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৪। উপরোক্ত নিয়ম মেনে চললে প্রতিদিন কিছু সময় রোগী, দেহে জমে থাকা এবং খাবারের সাথে গ্রহণ করা চর্বি ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করে চলবে। সাথে সাথে তাদের দেহে কিটোন তৈরি হয়। কিটোন আমাদের মস্তিষ্ক এবং হৃদপিণ্ডের প্রিয় খাবার। কিটোন আবার হরমোনের মতোও আচরন করে। কিটোন দেহ কোষের প্রদাহ কমায়। জিনগত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে বাধা দেয়। ক্যান্সার টিউমার এই অবস্থায় চাপের মধ্যে থাকে। কিটোনের উপস্থিতি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে,  রোগীর মনোবল ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে, ব্যাথা কমায়, পেশী ক্ষয় রোধ করে ইত্যাদি। এছাড়াও কিটোন আরও বিভিন্ন উপায়ে ক্যন্সার টিউমার কে দমন করতে সহায়তা করে।
৫। এমন জীবনধারা পালন করলে, প্রচলিত চিকিৎসা (কিমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি) রোগীর ক্ষেত্রে আরও কার্যকর হয় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়। 

৬। উপরোক্ত নির্দেশনা মেনে চললে, প্রফেসর টমাস সেয়ফ্রিড সম্প্রতি বলেছেন যে কৃমিনাশক ঔষধ আলবেন্ডাজল বা মেবেন্ডাজল প্রতিদিন গ্রহণ করলে, উপকার পাওয়া যায়। 

এবারে চলুন যারা বিস্তারিত জানতে চান, তাদের জন্য বিস্তারিত আলোচনায় ফিরে যাই। 

কারনঃ

ক্যান্সার কেন হয়? নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। কিন্তু ক্যান্সার রোগের কারন সম্পর্কে দুই ধারার ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। জনপ্রিয় ধারা টি হচ্ছে যে, "জিনগতত্রুটি থেকে ক্যান্সার হয়"। অন্য নামে এই ধারা কে বলা হয় "সোমাটিক মিউটেশন তত্ব"। এই তত্বের মুলমন্ত্র হল যে কোন প্রাণীকোষের বিভাজনের সময় এর ডি এন এ এর মধ্যে যে জিন থাকে, তার গঠন অনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। যদি স্বাভাবিক অবস্থায় এমন কোষগুলো দেহ নিজেই ধ্বংস করে ফেলে, কিন্তু কোনভাবে যদি কোষটি দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কে ফাকি দিয়ে টিকে থাকতে পারে এবং পরবর্তীতে আরো এমন জিনগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়, তাহলে কোন এক সময় তা ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়। বর্তমানে বাজারে যে সকল চিকিৎসা প্রচলিত আছে, সেগুলো সবই প্রায় এই তত্ব নির্ভর।  

অন্য যে ধারাটি রয়েছে, সেটি দাবী করে যে, কোন কারনে দেহ কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া যদি দীর্ঘদিন খতিগ্রস্থ অবস্থায় থাকে এবং সেই কোষ মাইটোকন্ড্রিয়ার ভেতর অক্সিজেন ব্যবহার করে যথেষ্ট শক্তি উৎপাদনে ব্যর্থ হতে থাকে, তখন বেঁচে থাকার তাগিদে সেই কোষ, কোষের সাইটোপ্লাজমে ফারমেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন ছাড়াই শক্তি উৎপাদন শুরু করে। একে বলা হয় সাবস্ট্রেট লেভেল ফস্ফরিলেশন। আংশিক বিকল মাইটোকন্ড্রিয়া সম্পন্ন সেই কোষের বৃদ্ধি এবং  ধ্বংস কে নিয়ন্ত্রণ করার যে শারীরিক ব্যবস্থাপনা, তা ভেঙ্গে পরে (কেননা মাইটোকন্ড্রিয়া এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে)। ফলে কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তেই থাকে এবং অমরত্ব লাভ করে, যাকে আমরা ক্যান্সার বলি। 

সেই ১৯২০ এর দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী জার্মান বিজ্ঞানী অটো ওয়ারবারগ ক্যন্সার সম্পর্কে এই তথ্য উদঘাটন করেন। এই ধারা ক্যান্সারের "মেটাবলিক তত্ব" নামে পরিচিত। এই তত্ব মতে, ক্যান্সার হাওয়া এবং হয়ে গেলে তার ব্যাবস্থাপনা, দুটো ক্ষেত্রেই খাদ্যাভ্যাস বিশাল ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ, খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, ক্যান্সার কে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই তত্ব নিয়ে খুব বেশী গবেষণা অবশ্য হচ্ছে না, কেননা, এই তত্ব প্রমানিত হলে, নতুন কোন ঔষধ বাজারে ছাড়ার সুযোগ নেই এবং তাই ব্যবসারও সুযোগ নেই। যৌক্তিক কারণেই তাই চিকিৎসা গবেষণায় সবথেকে বেশী পয়সা যারা বিনিয়োগ  করেন, অর্থাৎ ফারমাসিউটিকল কোম্পানি গুলো, তারা এই বিষয়ে গবেষণায় পয়সা ঢালতে চান না। 

এই তত্বগুলোর কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মত বিরোধ থাকলেও, একজন ক্যান্সার রোগীর চাওয়া শুধু একটিই, আর তা হল যে কোন প্রকারে সেরে ওঠা বা রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা। সুখবর হচ্ছে যে এই দুই তত্ব ভিত্তিক সমাধানই রোগীরা একসাথে ব্যবহার করে উপকার পেতে পারেন।গবেষণায় দেখা গেছে যে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা অনুসরণের সাথে অল্প পরিমাণে কিমোথেরাপি ঔষধ ব্যাবহার করলে, চমৎকার ফল পাওয়া যায় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়। ক্যান্সার রোগীর জন্য এই তথ্য জানা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

সীমাবদ্ধতাঃ 

 সোমাটিক মিউটেশন তত্ব যদিও গত অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, প্রফেসর টমাস শেফ্রিড সম্প্রতি তা সঠিক নয় বলে প্রশ্ন তুলেছেন এবং একাধিক শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। এই লেখাটিকে নাতিদীর্ঘ রাখার উদ্দেশ্যে, এখানে আমরা দুটো প্রমাণের কথা উল্লেখ করব যেন পাঠক বিষয়টি নিয়ে মোটামোটি সন্তুষ্ট হতে পারেন। 

আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই যে সোমাটিক মিউটেশন তত্ব মতে, দেহকোষের নিউক্লিয়াস (বা প্রধান কার্যালয়) এর ভেতর থাকা ডি এন এ যদি কোন কারণে এমন ভাবে পরিবর্তন হয়ে যে, ক্যান্সার সৃষ্টিকারী জিন সক্রিয় হয়ে যায়, তখন সেই কোষটি ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়। অন্য কথায়, ডি এন এ এর মধ্যে জিনগত পরিবর্তনের কারণেই কোন কোষ ক্যন্সার কোষে পরিণত হয়। 

কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ৩৫% ক্যান্সার কোষে কোনপ্রকার জিনগত পরিবর্তন থাকে না, বলেছেন প্রফেসর সেফ্রিড। অর্থাৎ একটি সুস্থ্য কোষের ডি এন এ এর সাথে তুলনায় কোন অস্বাভাবিক পরিবর্তন না থাকার পরেও এই কোষগুলো ক্যান্সার কোষের মত আচরন করে। যদি জিনগত পরিবর্তনই ক্যান্সারের কারণ হয়, তাহলে এই কোষ গুলো কিভাবে ক্যান্সার কোষে পরিণত হল? এই গবেষণা প্রতিবেদনে, গবেষকগণ এমনই অনেকগুলো প্রশ্ন তুলেছেন।  

কসমেটিক সার্জারি করার পরে ফেলে দেয়া কোষের ডিএনএ  পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তাদের অনেকগুলোর মধ্যেই ক্যন্সার সৃষ্টিকারী জিন সক্রিয় হয়ে আছে অথচ কোষটি স্বাভাবিক এবং সুস্থ! যদি জিনগত পরিবর্তনই ক্যান্সারের কারণ হয়, তাহলে এই কোষগুলো ক্যান্সার আক্রান্ত নয় কেন? 

অন্য গবেষণায়, গবেষকগণ ক্যান্সার কোষের নিউক্লিয়াস (যার ভেতরে ডি এন এ তথা জিন থাকে)  একটি সুস্থ্য কোষের নিউক্লিয়াস দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন। অর্থাৎ এই অবস্থায় ক্যন্সার কোষের মধ্যে কোন জিনগত ত্রুটি নেই। কিন্তু কোষটি তারপরেও ক্যান্সার কোষের মত আচরন করে এবং বিভাজিত হতে থাকে। অর্থাৎ কোষের মধ্যে কোন জিনগত পরিবর্তন না থাকার পরেও তা ক্যান্সার কোষ।

এর ঠিক উল্টোটাও করা হয়েছিল; একটি সুস্থ্য কোষের নিউক্লিয়াস কে প্রতিস্থাপন করে সেখানে একটি ক্যান্সার কোষের নিউক্লিয়াস বসিয়ে দেবার পরেও দেখা যায় যে কোষটি স্বাভাবিক কোষের মতোই আচরন করছে। অর্থাৎ জিনগত ত্রুটি উপস্থিত থাকার পরেও সেটি সুস্থ্য কোষ। 

এতে প্রমাণিত হয় যে, জিনগত পরিবর্তন প্রকৃতপক্ষে ক্যান্সার এর কারণ নয়। 

এই বিষয়ে যারা আরো বিস্তারিত জানতে চান, তারা ইউটিউবে প্রফেসর সেফ্রিডের এই আলোচনাটি শুনতে পারেনঃ https://youtu.be/JjNuZrsKDn4?si=ROn026-PL5QgBYp_ 

তাহলে জিনগত পরিবর্তন কেন হয়? প্রফেসর সেফ্রিড বলেন যে এটি হচ্ছে কোন কোষ ক্যান্সার কোষে রূপ নিলে, তখন তার ডিএনএ এর মধ্যে পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ, জিনগত পরিবর্তন আসলে ক্যান্সারের  কারণ নয় বরং ফল।   

চলুন, এবার এই ধারনাটি একটু বিস্তারিতভাবে বোঝার চেষ্টা করি। 

ক্যান্সারের মেটাবলিক ব্যাখ্যাঃ

মাইটোকন্ড্রিয়া হচ্ছে আমাদের দেহ কোষের শক্তির প্রধান কারখানা। জ্বালানি হিসাবে এই কারখানায় গ্লুকোজ (বা চিনি), আমিষ এবং চর্বি ও চর্বি থেকে উৎপাদিত কিটোন ব্যবহার হয়। স্বাভাবিক অবস্থায়, এই কারখানা অক্সিজেন ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করে

কোষের শক্তি উৎপাদনের অন্য যে উপায় আছে, সেটি কোষের সাইটোপ্লাজম (substrate level phosphorilation) এবং মাইটোকন্ড্রিয়ায় (mitochondrial substrate level phosphorilation) অক্সিজেন ছাড়া গাঁজন প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদনের উপায় যেখানে যথাক্রমে গ্লুকোজ এবং গ্লুটামিন নামক এমিনো অ্যাসিড জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই উপায়ে চর্বি বা চর্বি থেকে পাওয়া উপাদানকে (যেমন কিটোন) জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। অন্য কথায়, সুস্থ কোষের সাথে ক্যান্সার কোষের খুব বড় একটি পার্থক্য হল, ক্যান্সার কোষ চর্বি বা চর্বিজাত পুষ্টিকনা ব্যবহার করতে পারে না।  এই কারখানায় অক্সিজেনের প্রয়োজন নেই, এবং অক্সিজেনের উপস্থিতি বরং এই কারখানার কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এই কারখানা খুব দুর্বল এবং এতে প্রচুর অপচয় হয়। তবে এই কারখানায় শক্তি উৎপাদনে সময় লাগে অনেক কম। তাই জ্বালানী ঘাটতি না থাকলে, এই কারখানা থেকে যথেষ্ট শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। 

১৯২০ এর দশকে, জার্মান বিজ্ঞানী অটো ওরারবারগ আবিষ্কার করেছিলেন যে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এর মাইটোকন্ড্রিয়া গঠনগত ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায় এবং কোষের শক্তি উৎপাদনের একমাত্র উপায় থাকে উপরে বর্ণিত ২য় ধরনের কারখানা থেকে। এই কারখানায় যেহেতু শক্তি উৎপাদন হয় খুব কম এবং অপচয় বেশী হয় কিন্তু প্রক্রিয়াটি অতি দ্রুত ঘটে, তাই কোষকে স্বাভাবিক কোষের অনেকগুণ বেশী জ্বালানী অর্থাৎ প্রধানত গ্লুকোজ ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করতে হয়। ক্যান্সার কোষকে তাই স্বাভাবিক কোষের তুলনায় ২০০ গুন পর্যন্ত বেশি গ্লুকোজ শুষে নিতে দেখা যায়। এই বিষয়টি ওরারবারগ ইফেক্ট নামে  পরিচিত। 

সম্প্রতি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের বোস্টন কলেজের অধ্যাপক ডঃ টমাস সিফ্রিড এই ধারনা কে কেন্দ্র করে নতুন গবেষণায় দেখতে পান যে তিনি বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার কোষের যত হাজার হাজার নমুনা পরীক্ষা করেছেন, তাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ার গঠন ত্রুটিপূর্ণ। তাই এই কোষগুলো প্রধানত চিনি ব্যবহার করেই শক্তি উৎপাদন করে। ব্রিগাম ইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রফেসর ডঃ বেণ বিকম্যান তার এই দাবী কে সমর্থন দিয়ে বলেন যে এখন পর্যন্ত মানব দেহাভ্যন্তরে এমন কোন ক্যান্সার টিউমার পাওয়া যায়নি যা চর্বি বা কিটোন ব্যবহার করতে পারে। 

ক্যান্সার কোষের এই গ্লুকোজ নির্ভরতা (ওয়ারবারগ ইফেক্ট) কে ব্যবহার করেই কিন্তু ক্যান্সার টিউমারের অবস্থান নির্ণয় করা হয়। পি ই টি  (পজিট্রন এমিশন টমগ্রাফি) বা পেট স্ক্যান, যার মাধ্যমে ক্যান্সার টিউমারের অবস্থান নির্ণয় করা হয়, তাতে রোগীর দেহে রেডিওঅ্যাক্টিভ বিশেষ ধরনের গ্লুকোজ ইনজেকশন আকারে দেয়া হয়। এরপরে পেট স্ক্যানার সেই জায়গা গুলো প্রদর্শন করে যেখানে কোষগুলো অস্বাভাবিক মাত্রায় এই গ্লুকোজ কে শুষে নিয়েছে। আর এই স্থান গুলোতেই ক্যান্সার টিউমারের অবস্থান। 

গ্লুকোজের ভূমিকাঃ

তাহলে আমরা জানলাম যে ক্যান্সার চর্বি কে জ্বালানী হিসাবে ব্যাবহার করতে পারে না এবং আমাদের সুস্থ্য কোষগুলো সহজেই তা করতে পারে যেহেতু তাদের মাইটোকন্ড্রিয়া সঠিকভাবে কাজ করে। অর্থাৎ আমরা যদি গ্লুকোজ বা শর্করা জাতীয় খাবার কম খাই এবং পরিবর্তে চর্বি বেশি খাই, তাহলে ক্যান্সার কোষ খাদ্যাভাবে ভুগবে এবং তার বৃদ্ধি ব্যহত হবে এমনকি তাদের মৃত্যুও হতে পারে। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর জন্য সেটা উপকারী।  

তবে সমস্যা হচ্ছে যে, গ্লুকোজ আমাদের সুস্থ্য কোষের জন্যও অত্যাবশ্যক এবং দেহে গ্লুকোজের উপর এতটাই নির্ভর করে যে, খাবারের সাথে আমরা গ্লুকোজ না খেলে, আমাদের কলিজা গ্লুকোনিওজেনেসিস নামক একটি উপায়ে প্রোটিন ও ফ্যাট ব্যবহার করে গ্লুকোজ বানিয়ে রক্তে মিশিয়ে দেয়। একদিক থেকে এটি খারাপ খবর কেননা দেহকে কে শতভাগ চিনিমুক্ত করা সম্ভব নয়; কিন্তু ভাল খবর হল যে  আমরা খাবার থেকে শর্করা পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিলেও ক্ষতির ভয় নেই।  এর অন্য উপকারী দিকটি হল, শর্করা খাওয়া বন্ধ করে দিলে, আমাদের দেহের স্বাভাবিক কোষগুলোও ইন্সুলিন সংবেদনশীলতা ফিরে পায় এবং কলিজার উৎপাদিত গ্লুকোজের একটা বিরাট অংশ পুরো দেহে ব্যবহৃত হয়। তার মানে, ক্যান্সার টিউমার, ভাগে কম গ্লুকোজ পায় এবং তার বৃদ্ধি ব্যহত হয়। 

কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে শর্করা খাওয়া বন্ধ করে দিলে, দেহ চলবে কি করে? গ্লুকোজ ছাড়া শক্তি উৎপাদন কি করে হবে? আর এই প্রশ্নের জবাব আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটু আগেই যেমন বলেছিলাম যে কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া সচল থাকলে, তা গ্লুকোজের পরিবর্তে চর্বি এবং চর্বি থেকে উৎপাদিত কিটোন ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করতে পারে। এই তথ্যটি বিশেষভাবে  গুরুত্বপূর্ণ এই কারনে যে এই তথ্য ব্যবহার করে আমরা ইচ্ছে মাফিক ক্যান্সার টিউমারকে চাপের মধ্যে ফেলতে পারি। আমরা যদি শর্করা খাওয়া বন্ধ রাখি, তাহলে ক্যান্সার টিউমার যা চর্বি বা কিটোনকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করতে পারে না, খাদ্যাভাবে ভোগে। অথচ, সুস্থ্য কোষ  গুলো দিব্বি চর্বি ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করে এবং স্বাভাবিক কাজ বজায় রাখে।

যদিও স্বাভাবিক অবস্থায় সামান্য পরিমাণ চিনি আমাদের দেহের জন্য অত্যাবশ্যক, কিন্তু চিনি খাওয়া বন্ধ করে দিলে যখন আমাদের দেহে কিটোনের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন দেহ কিন্তু চিনির উপর নির্ভর করে না। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় গবেষক ডঃ আরনেস্ট ড্রেনিক অতি মোটা রোগীদের ২ মাস উপোষ করানোর পরে তাদের রক্তে যখন কিটোন ৮ মিলি-মোল এর কাছাকাছি উঠে যায়, তখন তিনি ইন্সুলিন ইঞ্জেকশন দিয়ে তাদের রক্তের চিনি ০.৫ মিলি-মোল  মাত্রায় নামিয়ে আনার পরেও তারা দিব্বি বেঁচে ছিলেন এবং সুস্থ্য ছিলেন। তাতে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের দেহ কমপক্ষে একটি জ্বালানী উপস্থিত থাকলেই স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে পারে।  

কিটোন পার্শ্ব-উপকারিতাঃ

সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে যে, কিটোন মানব দেহের জন্য দুই উপায়ে উপকারী। কিটোন জ্বালানী এবং হরমোন হিসাবে কাজ করে। আমাদের দেহে কিটোনকে যেমন জ্বালানী হিসাবে ব্যাবহার করা যায়, তেমনি, কিটোন কোষের মধ্যকার প্রদাহ এবং দহনজনিত চাপ কমায়। ফলে রোগী অনেক ভাল অনুভব করতে শুরু করে। অন্য দিকে চর্বি ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদনের কারনে, দেহের জমে থাকা চর্বি ব্যবহৃত হয় অধিক মাত্রায় এবং রোগীর স্থুলতা থাকলে, তার ওজন কমে যায় চমৎকারভাবে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, এই প্রক্রিয়ায় দেহ পেশীকে বাঁচিয়ে শুধু চর্বিই ক্ষয় করে থাকে। 

ইন্সুলিনের ভূমিকাঃ

ক্যান্সার রোগীর খাবার থেকে শর্করা বাদ দেবার অন্য যে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি রয়েছে, তা হল ইন্সুলিন নামক হরমোন এর মাত্রা ন্যুনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা । ইন্সুলিন হরমোন একটি প্রবৃদ্ধি নির্দেশক হরমোন। এই হরমোন বাড়লেই, কোষ গুলো বিস্তারিত/বিভাজিত হবার সংকেত পায়। সুস্থ্য স্বাভাবিক কোষের ক্ষেত্রে বিস্তার নিয়ন্ত্রিত হয় কেন্দ্রীয় ভাবে। কিন্তু ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ অকার্যকর হয়ে পরে। ফলে, অধিক ইন্সুলিন থাকা মানেই টিউমারের দ্রুত বিস্তার। ক্যান্সার কোষে, স্বাভাবিক মাত্রা থেকে বহুগুন (১৫ গুন পর্যন্ত) বেশী ইন্সুলিন গ্রহণ করার দরজা বা ঘাট থাকে। শর্করা খাওয়া বন্ধ করে ইন্সুলিন বৃদ্ধি সীমিত করতে পারলে, ক্যান্সার বিভাজিত হবার সংকেত বা উৎসাহ পায় না এবং তার বৃদ্ধির গতি রহিত হয়। 

শর্করা না খেয়ে থাকা কি সম্ভব?

সন্দেহ নেই যে শর্করা খাওয়া বন্ধ করা খুব কঠিন কাজ এবং একজন সুস্থ্য মানুষের জন্য সেটা করার কোন বিশেষ কারনও নেই। কিন্তু একজন ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে চিত্রটিকে সঠিক প্রেক্ষাপটে বুঝতেই হবে। ক্যান্সার তো জ্বর-সর্দির মত সাধারণ অসুখ নয়। সুতরাং নিতান্ত অবুঝ শিশু না হলে, শর্করা খাওয়া বন্ধ করা কে খুব বেশী কঠিন মনে হবার কথা না।  বিশেষ করে, এই অভ্যাস শুরু করলে যখন রোগী দেখবেন যে এটি তেমন কঠিন কিছুই নয়, তখন আর তার কোন আপত্তি থাকবে না। 

বিষয়টিকে আরও একধাপ সহজ করে নেয়া যায়, যদি রোগী কিছুই না খান! তারমানে এই নয় যে রোগী কোনদিনই কিছু খাবেন না, বরং প্রতিদিন কত বেলা খাচ্ছেন, সেটা কমিয়ে একবেলা অথবা ছয় ঘণ্টার মধ্যে দুই বেলা খাবেন। ধরুন দুপুর ২টায় প্রথম খাবার খেলেন, তার পরে সন্ধ্যা ৮টার মধ্যে রাতের খাওয়া শেষ করে নিলেন। তাহলে দিনের বাকী ১৮ ঘন্টা থাকবে উপোষ। 

উপোষকে আমরা অনেকেই খুব ভয় করি। আমাদের পুষ্টিবিদ এবং চিকিৎসকরাও এতদিন আমাদের উপোষ করতে নিষেধ করতেন। কিন্তু ২০১৬ সালে জাপানের যে বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, তার গবেষণায় তিনি দেখিয়েছিলেন যে উপোষ করলে, আমাদের কোষগুলো নিজের ভেতরে কোন আবর্জনা থাকলে তা পরিষ্কার করে শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করে ফেলে। তিনি এই প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছিলেন অটোফ্যাজ়ি বা স্বতভুক্তি। ক্যন্সার রোগীর জন্য এটি বিশেষ উপকারী কেননা, পরিষ্কার হবার পরে সুস্থ্য কোষ গুলো অনেক বেশী সতেজ হয়ে ওঠে এবং রোগী হয়ে ওঠেন সতেজ। 

অন্য বিষয়টি হল যে, প্রতিবার খাওয়ার পরে, তা সে যাই খাই না কেন আমরা, আমাদের দেহ ইন্সুলিন হরমোন বাড়িয়ে দেয় রক্তে। চর্বি জাতীয় খাবার খেলে সব থেকে কম ইন্সুলিন নিঃসরণ হয়। তাই যদি আমরা বার বার না খাই, তাহলে ক্যান্সার টিউমার বার বার বিস্তারিত হবার উৎসাহ বা সংকেত পায় না এবং ক্যান্সারের বেড়ে যাবার গতি কমে যায়। রোগীর আয়ু বৃদ্ধি পায়। 

আরো যুক্তিঃ

সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডমিনিক ডি অগাস্টিনো, তার গবেষণাগারে ক্যান্সার নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। শর্করা খাওয়া বন্ধ করলে, তিনি দেখেছেন যে ক্যান্সার রোগী একাধিক উপায়ে উপকৃত হন। তিনি বলেন যে দেহে কিটোনের মাত্রা বাড়াতে পারলে (শর্করা না খাওয়া যার পূর্বশর্ত),

ইত্যাদি। 

প্রফেসর বেন বিকম্যান , প্রফেসর টমাস সিফ্রিড, ডাঃ কেন বেরি, ডাঃ জেসন ফাং এই দাবিগুলোকে সমর্থন করেন। প্রফেসর ডম ডি অগাস্টিনোকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, যদি তার আপন কারো ক্যান্সার হয় এবং প্রচলিত চিকিৎসায় কিছু করার না থাকে, তাহলে তিনি কি করবেন? জবাবে তিনি যা বললেন, তা আছে এই ভিডিওতেঃ https://youtu.be/q7kOs6bS1Hg?t=7255  বাংলা অনুবাদ দেখতেঃ https://youtu.be/G0EAMPcbjaI 

গ্লুটামিন এর কথাঃ 

গ্লুটামিন হচ্ছে ক্যান্সারের ২য় গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানী। প্রফেসর টমাস সেফ্রিড, ক্যান্সার জগতে তার সব চেয়ে বড় কৃতিত্ব হিসাবে দাবি করেন যে, তার অধীনে গবেষণায় তারা আবিষ্কার করেন যে, ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ, বিকল মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরে সাবস্ট্রেটলেভেল ফস্ফরিলেশন বা গাজন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে এটিপি বা শক্তি উৎপাদন করতে পারে। এই বিষয়টি কে ওনারা নাম দিয়েছেন 'কিউ ইফেক্ট' (Q effect)। 

গ্লুটামিন একটি এমিনো অ্যাসিড যা আমিষ জাতীয় খাবার থেকে পাওয়া যায়। তাহলে কি রোগীদের প্রোটিন খাওয়া বন্ধ করে দেয়া উচিৎ নয়? 

না, সেটা ঠিক হবে না। গ্লুটামিন মানব দেহের অনেকগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে। গ্লুটামিন এতো গুরুত্বপূর্ণ যে খাদ্য হিসাবে না খেলে, আমাদের দেহ নিজেই তা উৎপাদন করে এবং ব্যবহার করে। দীর্ঘ সময় ধরে যদি গ্লুটামিন কে অকার্যকর করে রাখা হয়, তাহলে আমাদের দেহ টিকবে না। 

তবে, গ্লুকোজ কমিয়ে রাখা অবস্থায়, মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্য দেহের গ্লুটামিনের পরিমাণ যদি আমরা কমিয়ে আনতে পারি, তাহলে দেখা যায় ক্যান্সার কোষ উভয় প্রকার জ্বালানী সঙ্কটে পড়ে এবং মরতে শুরু করে। এই কৌশলকে প্রফেসর সেফ্রিড নাম দিয়েছেন 'প্রেস-পালস' কৌশল। এর মূল মন্ত্র হচ্ছে খাবার থেকে শর্করা বাদ দেয়ার মাধ্যমে দেহের চিনির মাত্রা সর্বনিম্নে নামিয়ে আনা এবং প্রধানত কিটোন ব্যবহার করে চলা যেন ক্যান্সার কোষ তাদের প্রিয় খাবার না পায় এবং সার্বক্ষণিক চাপে থাকে, এবং সাথে সাথে মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্য গ্লুটামিন কমিয়ে দেয়া, যা ক্যান্সার কোষের মৃত্যু নিশ্চিত করবে।

গ্লুটামিন কমানোর জন্য একটি ঔষধ আছে, কিন্তু তা এফডিএ সমর্থিত নয়। নাম হচ্ছে 6-Diazo-5-oxo-L-norleucine বা সংক্ষেপে DON, যা দেহে গ্লুটামিন ব্যবহারে বাধা প্রদান করে। প্রফেসর সেফ্রিড এই ঔষধ সম্পর্কে দাবি করেন যে, এই ঔষধটি ক্যান্সার চিকিৎসায় সফলতা না দেখানোর কারণ হচ্ছে যে, কখনোই গ্লুকোজের মাত্রা সর্বনিম্নে রাখা অবস্থায় এটিকে পরীক্ষা করা হয়নি। ফলে, কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় নি। 

অন্য যে প্রাকৃতিক উপায়ে আমরা স্বল্প সময়ের জন্য গ্লুটামিন এর সরবরাহ কমিয়ে আনতে পারি, তা হল ব্যায়াম করা। যারা ব্যায়াম করতে পারবেন না, তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী উপোষ (পানি এবং লবণ খেয়ে) করা। ইন্টারনেট জগতে যারা ১০, ২০, ৪০ ইত্যাদি দিন উপোষ করে ক্যান্সার মুক্ত হয়েছেন বলে দাবি করেন, তাদের দেহে একই সাথে গ্লুকোজ এবং দীর্ঘদিন উপোষের পরে গ্লুটামিন ঘাটতি হবার কারণেই তেমনটা হয়ে থাকে বলে প্রফেসর সেফ্রিড দাবি করেন। 

গ্লুটামিন নিয়ন্ত্রণের জন্য তাই রোগীদের শর্করা শূন্য খাদ্যাভ্যাসের সাথে সাথে ব্যায়াম করা বা রোগের অবস্থা খারাপ হলে উপোষের মাধ্যমে তা কমানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। 

রোগীর সফলতার গল্পঃ

তত্বগতভাবে শর্করা না খাওয়া উপকারী হবে, আশা করি সেটা এখন আমরা একমত। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় কোন রোগী ভালো হয়েছেন বা বেশিদিন বেচেছেন, তার প্রমাণ আছে কি?  

জবাব হল, তেমন প্রমাণ আছে বলেই এই উপায়কে ব্যবহারে উৎসাহ বাড়ছে। এখানে দুই একটি রোগীর ইতিহাস উপস্থাপন করা হল।

মিরিয়াম কালামিয়ান এর ছেলে রাফির মাত্র তিন বছর বয়সে মস্তিষ্কের ক্যান্সার (গ্লিওব্লাস্টমা মাল্টিফরমে, জি বি এম) ধরা পরে। তার ছোট্ট মাথায় টিউমারটির আকার প্রায় একটা কমলা লেবুর সমান হয়ে গিয়েছিলো। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বলেছিলেন যে রাফি খুব বেশী হলে ৩ মাস বাঁচবে। মা মিরিয়াম, ছেলের প্রান বাঁচানোর জন্যে হন্যে হয়ে সমাধান খুঁজতে থাকেন। সৌভাগ্যবশত তিনি ডঃ টমাস সিফ্রিড এর গবেষণার কথা জানতে পারেন। উপায়ান্তর না দেখে, প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি রাফির খাবার থেকে শর্করা বাদ দিয়ে মাংশ এবং বিশেষ করে চর্বির পরিমাণ বাড়িয়ে দেন।  রাফির স্বাস্থ্যের চমৎকার উন্নতি দেখতে পান তিনি। পরে পেট স্ক্যান থেকে দেখা যায় যে রাফির টিউমার বড় হবার পরিবর্তে খানিকটা সংকুচিত হয়েছে। এই ফল দেখে তিনি এতটাই উৎসাহিত হয়ে পড়েন যে নিজেই একটা ৩ বছর মেয়াদী পুষ্টিবিদ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি এই খাদ্যাভ্যাসের ফল হিসাবে, রাফি আরও ১০ বছর বেঁচেছিল। আর একেবারে শেষের দিনগুলো ছাড়া বাকী সময়, সে তার জীবন পুরদমে উপভোগ করে গিয়েছে। মিরিয়াম তার ওয়েবসাইটে এই বিষয়ে বিস্তারিত দিয়ে রেখেছেনঃ https://www.dietarytherapies.com/ 

জেন ম্যাক্লাল্যান্ড হচ্ছেন এমন আরেকজন ক্যান্সার যোদ্ধা। ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু করে, ৩ বার তাকে ক্যান্সার আক্রমণ করে এবং প্রচলিত চিকিৎসার পাশে, কিটোজেনিক খাদ্যাভ্যাস ব্যবহার এবং সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করে তিনি তিন বারই ক্যান্সারকে পরাজিত করে এখনো দিব্বি বেঁচে আছেন।  তিনিও পরে তার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে একটি বই লিখেন, যার নাম হচ্ছে 'হাউ টু স্টারভ ক্যান্সার' বা 'ক্যানসারকে কিভাবে না খাইয়ে মারা যায়'। ফেসবুকে তার একটি গ্রুপ রয়েছে যেখানে তিনি ক্যান্সার রোগীদের সাথে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তার ওয়েব সাইট হলঃ  https://www.howtostarvecancer.com/

দন্ত-চিকিৎসক ডাঃ আল ডেনেনবারগ যখন জানতে পারলেন যে তার ক্যান্সার হয়েছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তার ক্যান্সার ছড়িয়ে পরেছিল সারা দেহে। এমন কি হাড়ের মধ্যেও। ডাক্তার বলেছিলেন যে তার মাত্র কয়েক সপ্তাহ সময় বাকী আছে। ইন্টারনেটে সমাধান খুঁজতে গিয়ে তিনি ডাঃ পল সালাদিনোর একটি ইউটিউব ভিডিও খুঁজে পান যেখানে ডাঃ সালাদিনো ব্যাখ্যা করেছিলেন যে কেন শুধুই মাত্র মাংশ খেলে (অর্থাৎ প্রায় শূন্য পরিমাণ শর্করা খেলে) ক্যান্সার ভাল হতে পারে। ডাঃ ডেনেনবারগ দেরি না করে  প্রচলিত চিকিৎসার সাথে সাথে এই উপদেশ অনুসরণ করেন এবং তিনি এখনো বেঁচে আছেন। শেষবার যখন পেট স্ক্যান করা হয়েছিলো, তার দেহে ক্যান্সারের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নি। তার নিজের মুখেই তার ইতিহাস শুনুনঃ https://youtu.be/8pI3jrNPclw

ডাঃ নিশা উইন্টারস নিজেও একজন ক্যান্সার জয়ী। তিনিও ক্যান্সারের বিরুদ্ধে তার বিজয়ের পেছনে শর্করা খাওয়া সীমিত করাকে দায়ী করেন। ডায়েট ডাক্তার ডট কম এর ডাঃ ব্রেট শার এর সাথে তার আলচনা শুনুন https://youtu.be/AiygT8KeQXI

আরও অনেক এমন উদাহরণ রয়েছে আমাদের সামনে। কিন্তু রচনাটি সংক্ষিপ্ত রাখার উদ্দেশ্যে, সব গল্পগুলো তুলে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এবারে চলুন জেনে নেই যে কিভাবে একজন ক্যান্সার রোগী এই খাদ্যাভ্যাস করতে পারেন।

সীমিত শর্করা - কি করে করবো? 

খুব ভালো প্রশ্ন। বিশেষ করে যে দেশে বিশাল সংখ্যায় মানুষ জানেই না 'শর্করা' আসলে কি এবং কোন কোন খাবারে শর্করা থাকে, তাদেরকে সীমিত শর্করার ধারনা দেওয়া নিঃসন্দেহে কঠিন। এই সমস্যার সমাধানের একটি সহজ উপায় হল, কোন খাবারই না খাওয়া, অন্য কথায় 'উপোষ' করা। মানুষের সব থেকে লম্বা উপোষের ইতিহাস হচ্ছে ৩৮২ দিনের, তাই সামান্য ১৮ ঘণ্টা উপোষ করা, মোটেও দুর্ভাবনার বিষয় নয় এবং উপোষ করলে, কোন খাবার গুলো খাওয়া যাবে না, সেই ভাবনা ভাবতেই হবে না। 

কিন্তু দিনের বাকী যে ৬ ঘণ্টা থাকবে, তখন আমরা কি খাব?  এই প্রশ্নের উত্তর কে সহজ করার জন্য আমরা জেনে নিতে পারি যে কোন খাবারগুলোতে শর্করা নেই। দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার গুলোকে বাদ দিয়ে আমরা যদি প্রাণী থেকে পাওয়া খাবার গুলো খাই, তাহলে নির্ভরতার সাথে খাবারের শর্করার পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যায়। মাছ, মাংশ, ডিম ইত্যাদি সব খাবার গুলো প্রায় শর্করা শূন্য। প্রাণীজ তেল- চর্বি, নারকেল তেল, অলিভ তেল, এভোকাডোর তেল ইত্যাদিতেও শর্করা নেই, তাই এগুলো বেশী খেলে দোষ নেই। বীজতেল বা আমরা যেগুলোকে উদ্ভিজ্জ্য তেল বলি যেমন সয়াবিন, সরিষা, ভুট্টা, তুষ, সূর্যমুখী, ক্যানোলা ইত্যাদি তেল গুলো খুব দ্রুত অক্সিডাইজড হয় বলে, দেহে প্রদাহ বাড়ায়। তাই সেগুলো না খাওয়াই ভাল। 

যদি খাবারের প্রধান অংশ হয় চর্বিযুক্ত মাংশ, কয়েকটি ডিম, এবং সামান্য একটু সবুজ শাক বা সবজি (ভাত, রুটি বা আলু বা এমন যে কোন বীজ ভিত্তিক উদ্ভিজ্য খাবার বাদ দিয়ে), তাহলেই আর কি খাব বা খাব না, এসব ভাবতে হবে না। 

দুধ এবং দুগ্ধজাতীয় খাবারগুলোতে যেহেতু প্রবৃদ্ধি হরমোন বেশী থাকে, তাই ক্যান্সার রোগের ক্ষেত্রে, তা খাওয়া থেকে বিরত থাকাই নিরাপদ। এমনকি হরমোন সংবেদনশীলতা যে সকল ক্যান্সারের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে, তাদের ক্ষেত্রে মাখন বা ঘি খাওয়াও নিরুৎসাহিত করা হয়। 

সংক্ষেপে যা করা উচিতঃ 

যদি আপনার কোন ধরনের ক্যান্সার ধরা  পড়ে থাকে, তাহলে নিজের নিয়ম গুলো অনুসরণ করলে উপকার হবার কথাঃ 
১। সকালে কিছু খাবেন না (তাহলেই নিজের অজান্তেই আপনার ১৭/১৮ ঘণ্টা উপোষ করা হয়ে যাবে) যদিও পানি এবং কালো চা/কফি খেতে পারেন।
২। দুপুর এবং রাতে দুই বেলা খাবেন এবং শর্করা একদম খাবেন না। মাংশ, মাছ, ডিম খাবেন পরিমান মতো (কমও নয়, বেশিও নয়)।
৩। স্বাস্থ্যকর চর্বি (প্রাণীর চর্বি, ঘি, মাখন বা নিদেন পক্ষে নারকেল তেল) বেশি করে খাবেন (এড়িয়ে যাবেন না)।
৪। বাজারের কোন তেল খাবেন না। 

আর কোন চিকিৎসা আছে কি?

প্রচলিত ক্যান্সার চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো খুব সফল না হলেও, আমরা সবাই এদের কথা জানি। যেমন কিমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, অস্ত্রোপচার ইত্যাদি।  প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত একজন অঙ্কলজিস্ট বা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ এর বাইরে আরও কোন চিকিৎসার কথা সাধারণত বলতে পারেন না। কিন্তু সত্য কথা হল যে এর বাইরেও মানুষ ক্যন্সার চিকিৎসায় আরও অনেক কিছু করেন।  এই চিকিৎসা গুলোর কথা সকলে জানেন না। নিচে এমনি কিছু চিকিৎসার কথা আমরা এখন বলব; তবে মনে রাখবেন যে এই চিকিৎসায় সকলেই ভালো হবেন, এমন কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেন না। 

সর্ব প্রথম উল্লেখ করব কেয়ার অঙ্কলজি ক্লিনিক এর কথা। আমেরিকায় এবং ইউ কে এর লন্ডন শহরে এই ক্লিনিক অবস্থিত। বেশ কিছু বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার রোগীর সাফল্যের উপর ভিত্তি করে, এই ক্লিনিক রোগীদের কে পরীক্ষামূলক ভাবে মাত্র ৪টি অতি ব্যবহৃত এবং অত্যন্ত সস্তা ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করেন। তাদের এই চিকিৎসা পদ্ধতি সম্প্রতি, প্রচলিত চিকিৎসার তুলনায় অনেক বেশী সফলতা দেখেছে। 

কেয়ার অঙ্কলজি ক্লিনিকের চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন

কেয়ার অঙ্কলজি ক্লিনিকের প্রকাশিত সফলতার প্রবন্ধ পাবেন এই ঠিকনায়ঃ https://www.frontiersin.org/articles/10.3389/fphar.2019.00681/full

ঔষধের মূল্য কম হলেও, চিকিৎসকের সাথে কথা বলার জন্য এই ক্লিনিক খুবই ব্যয় বহুল। এক ঘন্টার একটি আলোচনার জন্য তারা, সব শেষ তথ্যমতে ৪০০ পাউন্ড (প্রায় ৪৩০০০ বাংলাদেশী টাকা) মূল্য নিয়ে থাকেন। এরপর প্রতি ৩ মাস পরপর তাদের সাথে অবস্থার পর্যালোচনা করতে হয় যার মূল্য ২৫০ পাউন্ড (প্রায় ২৭০০০ বাংলাদেশী টাকা)।  যাদের সামর্থ্য আছে, তারা অবশ্যই তাদের সাহায্য নিতে পারেন। আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে, আমরাও এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারব।